এলোমেলো আমি-৭
এলোমেলো আমি-৭
এই শহর আমাকে ক্লান্ত করে. আবার এই শহরটাকে আমার ভালো যে লাগেনা তা নয়. নিজেকে অনেকবার জিজ্ঞেস করেছি ঠিক কেন এই দ্বন্দ্বের মধ্যে আমি থাকি এই শহরটাকে নিয়ে. এই শহরের কোনায় কোনায় ছড়িয়ে আছে আমার নানান স্মৃতি. সেগুলি একই সঙ্গে যেমন আমার চরম বিষাদের কারণ তেমনি ওই স্মৃতিগুলো না থাকলে আমার কাছ থেকে অনেক আপনজনের মত সম্পদ চলে যাবে, যেগুলিকে আমি কিছুতেই হারাতে চাই না. অনেক বন্ধুর মত আমার আরেক বন্ধু ছিল অপর্ণা. ওর সঙ্গে আমার বন্ধুত্বকে যেমন আমি মিস করি. নানা জায়গায় অপর্ণা আর আমার ঘুরে বেড়ানোর স্মৃতি ছড়িয়ে আছে. তখন অপর্ণার ছেলে সবে হয়েছে. ওর ছেলে ঋষি আমার প্রায় কলে পিঠে চড়ে বড় হয়েছে বলা যায়. ওর গায়ে যে গন্ধটা ছিল তা আমি টের পেতাম এক মাঠ সবুজের কাছে গেলে. এই গন্ধ বিষয়টি আমাকে পাগল করে রাখে. বিভিন্ন মানুষের শরীরে ভিন্ন ভিন্ন গন্ধ আছে. সেই সব গন্ধ আমাদের স্মৃতির ভিতরে যে কতকাল ধরে বাসা বেঁধে থাকে কে জানে! কিন্তু সেই সব গন্ধগুলো প্রানের গন্ধ. যেমন গার্গীর শরীরেও যে গন্ধটা ছিল তা অতি পবিত্র. আমি সারাদিন পর যখন গার্গীর সঙ্গে দেখা হত, তখন ওর শরীরে নিজেকে ডুবিয়ে দিয়ে থাকতাম. কেমন এক আশ্রয় ছিল আমার জীবনে গার্গী.
মনে আছে গার্গীর আমার দিকে চোখ তুলে তাকানোর কথা. মনে আছে একসঙ্গে শুয়ে যখন আমি ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়তাম, তখন ও আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিত. ওদের বাড়ির একটা বিশেষ জানলা ছিল. জানালাটিকে আমরা আদর করে দাঁড় বলে ডাকতাম. কারণ সবাই শুয়ে পড়লে আমরা দুজন সেই দাঁড়ে বসে কত কথায় না বলতাম. সিগারেট খেতাম. আর কথা বলতাম. কত কত বিষয়ে যে আমাদের কথাবার্তা ঘুরে বেড়াত বলার না!
শুধু কথাবার্তায় না, আমার প্রতিটি বিষাদের মুহুর্তে গার্গী আমার সঙ্গে থাকত. এমন কোনো কথা ছিল না যা আমি ওকে বলতাম না. আর ও আমাকে অসম্ভব বিশ্বাস করত. আমার মনে পরে দিদুনের কথা, যাঁকে মৃত্যুর কয়েকদিন আগে দেখতে গিয়েছিলাম আমি. উত্তরপাড়া স্টেট জেনেরাল হাসপাতালে. তার সেই চোখ আমি ভুলব না. সেই ঘর আমি ভুলব না. তাঁর শেষ কয়েকদিন আমার সঙ্গে রোজ দেখা হয়েছে. একজন নির্বাক, মৃত্যুপথযাত্রী, সংজ্ঞাহীন মানুষ, আমার দিকে একদিনই তাকিয়ে ছিলেন. যেদিন উনি মারা গেলেন, সেদিন আমরা সকলে তাঁর শেষ মুহূর্ত এমনকি ঘট ভেঙ্গে বেরিয়ে আসার মুহূর্ত পর্যন্ত ছিলাম তাঁর সঙ্গে. গার্গীর আত্মীয়স্বজনদের কথাও মনে পড়ছে. গার্গীর আমার উপর বিশ্বাস ছিল যেরকম, আমি তার মর্যাদা দিতে পারিনি. এখন বুঝি কী হারিয়েছি আমি! কারণ যার সঙ্গেই আলাপ হোক না কেন, যার সঙ্গে যেরকমই সম্পর্ক হোক না কেন, আমার মনে পড়ে গার্গীর কথা. মায়ের পরে এই একটি মানুষ আমাকে নি:স্বার্থ ভাবে ভালোবেসেছেন. এই একটি মানুষের সঙ্গে আমার কিছু না কথা বললেও অনেক কথা বলা হয়ে যেত. আমাদের বইয়ের দিন মনে পড়ছে. মনে পড়ছে সেই দুপুরগুলো. আমাদের এক সঙ্গে শান্তিনিকেতন যাওয়া. আমাদের বিয়ে হয়েছিল ১ মে. আমরা কোথাও না যেতে পারলেও তার পর থেকে প্রতি বছর ওই দিন কোথাও না কোথাও যেতাম. বেশিরভাগটাই মন্দারমণি, দীঘা, বকখালি. শান্কার্পুরের সেই সৈকত. আমাদের শেষ ভ্রমন দীঘা.
ওকে ছাড়া আমি আর কোনদিনই কোনো সমুদ্রতীরে যেতে পারব না.
কোনদিন শান্তিনিকেতনের সোনাঝুরিতে যেতে পারব না.
কোনো দিন হস্তশিল্প মেলাতে যেতে পারব না.
কিন্তু আমি কি পাগল হয়ে গেছিলাম? আমাকে ওর ছেড়ে চলে যাবার পিছনে আমি-ই দায়ী. এ কথা আর কোথায়-ই বা স্বীকার করব!
আমি ওকে অনেক কষ্ট দিয়েছি.
আর সেই সব কষ্ট আমার প্রতিটি দিন, প্রতিটি রাত্রির ভিতরে ফিরে আসে.
আমাকে যন্ত্রনা দেয়.
যখন খুব শ্বাসকষ্ট হয়, তখন ওকে আঁকড়ে ধরতে ইচ্ছে হয়.
সুযোগ পেলাম না আমি.
কবিতায় কি আমার উপর প্রতিশোধ নিল? গার্গী আমাকে বারবার বলত কিছু চাইনা, অল্প নিই থাকা সম্ভব. কিন্তু আমাকে লিখতে হবে.
তাই কি আমি আর লিখতে পারছি না?
আমার কি এভাবেই মৃত্যু হবে?
হয়ত তাই.
(ক্রমশ)
Comments
Post a Comment