এলোমেলো আমি-৯


এলোমেলো আমি-৯ 


এই একটু আগে আমাকে ফোন করলেন প্রশান্ত মাঝি. বহুদিন পর তাঁর সঙ্গে কথা হলো. মনে আছে ভাস্করদার চিলেকোঠায় সকলে মিলে আড্ডা দেবার কথা. কী সুন্দর ছিল সেই সব দিন. ভাস্করদার মৃত্যুর দিনটি হঠাত মনে পড়ল. সেদিন ছিল এক শনিবার. আমাকে সার্থক ফোনে জানালো ভাস্করদা আর কবিতা লিখবেন না. শুনে আমি ভেঙ্গে পড়লাম. জানতাম এই দিনটা একদিন আসবেই. কারণ কান্সারে ভুগছিলেন ভাস্করদা. খুব কষ্ট পাচ্ছিলেন. তাঁর পা দুটো কেমন সরু হয়ে গেছিল. আমি ছুটলাম. গিয়ে পৌছলাম যখন বরানগর তখন ভাস্করদাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে কাছেই কুটিঘাট-এ. ভাস্করদার বাড়িতে বাসবিদি তখন কথা বলার মত অবস্থায় ছিলেন না. শুনলাম শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে. একটা রিক্সা করে ছুটলাম. গিয়ে দেখলাম তখন শঙ্খবাবুও এসে গেছেন. সন্দীপন এসে গেছে. ভাস্করদার প্রচুর বন্ধু এসে গেছেন. অভীককে কোথাও দেখতে পেলাম না. বুঝলাম এই দৃশ্য সহ্য  করা অভীক-এর পক্ষে কঠিন. আরেক অভীক দা চলে এসেছেন. আমি ঢুকে দেখলাম ভাস্করদা শুয়ে. মুখে সেই প্রশান্ত মধুর হাসি. সুমন্ত সব কাজ করছে. কৌশিক হাজির. আমি আর বেশিক্ষণ সহ্য  করতে পারলাম না. আমিও চুল্লির সামনে থেকে বেরিয়ে কুটিঘাট-এ যে  বটগাছ আছে সেটি পেরিয়ে চলে গেলাম গঙ্গার ঘাটে. এ দিকে আমার পিছনেই কাঠের আগুনে শেষ হয়ে যাচ্ছেন আরেক জন. তার আঁচ এসে লাগছে আমার গায়ে. আমি চুপ করে বসে রইলাম. একবার শঙ্খবাবুর কাছে গেলাম. তখন শিবাজিদাও চলে এসেছেন. ভুমেন্দ্র গুহ এসেছেন. আমি আর সার্থক বসে রইলাম আবার ঘাটে. মাঝখানে একবার চুল্লির কাছে এসে দেখি মৃদুলদা এক প্যাকেট গোল্ড ফ্লেক পুরে দিলেন ভাস্করদার পকেটে. 
মনে পড়ল ভাস্করদার অমোঘ লাইন - যখনি মৃত্যুর কথা মনে পরে সিগারেট ধরাই.
একটু একটু করে বৃষ্টি শুরু হলো.
ভেসে গেলাম.
আবার ফিরেও পেলাম.
কিরকম আছ মানুষেরা, জিরাফের ভাষা আমাকে নিয়ে গেল আবার অন্য কোনো জায়গায়. 
আমি এখনো সেই জায়গা থেকে বেরোতে পারিনি.
যাই হোক, আজ অনেক দিন বাদে সৌম্যদার সঙ্গে কথা হলো ফোনে. সৌম্য দাশগুপ্ত. অসামান্য কবি. আমাকে নানা সময়ে নানা ভাবে উপকার করেছেন. এমনকী প্রয়োজনের সময়ে অর্থসাহায্য-ও করেছেন. 
অগ্রবীজ বলে একটি অসামান্য কাগজ করেন তাঁরা দেশের বাইরে থেকেই. বাংলাদেশ, ভারত, এবং প্রবাসী বাঙালিরা মিলে এই কাগজ করেন. একটু অনিয়মিত. কিন্তু অত্যন্ত মননশীল কাগজ.
আমি আজকেই বলছিলাম সৌম্যদা কে. আমি কখনই কাউকে বলতে পারি না বা কোনো কিছুকে নস্যাত করে দিতে পারি না. আমার অস্বস্তি হয় তাদের সঙ্গে কথা বলতে বা তাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে যারা খুব তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্তে চলে আসে. একে খারাপ, ওকে ভালো ইত্যাদি বলে দেয়. আমি কে বিচার করার? আমি বড়জোর বলতে পারি আমার ভালো লাগছে কি না এই সময়ে দাঁড়িয়ে. 
তবে একটা বিষয়, গড় কবিতা এবং সত্যিকারের কবিতার মধ্যে ফারাক তো আছেই. 
গড় কবিতা বলতে আমি কি বললাম? 
বেশিরভাগ কবির ক্ষেত্রে যেটা হয়, তা হলো, একবার লেখা কি তা জেনে গেলে, তার পর সেই লেখার কৌশল কে অস্ত্র করে লেখার পর লেখা তাঁরা লিখে যান. এ ক্ষেত্রে যেটা থাকে না তা হলো সেই লেখকের ব্যাক্তিত্ব -এর প্রকাশ.
বুঝতে পারিনা তাঁরা কেন লিখছেন.
কেন আমাকে লিখতে হবে সেটা খুব গুরুত্বপুর্ণ বিষয়.
আমি নিজেকে প্রশ্ন করে দেখেছি, এই যে আমার অনেক দিন ধরে কিছু লেখা হচ্ছে  না, আমার মানসিক ভারসাম্য  নষ্ট হয়ে যাচ্ছে এতে. কিন্তু আমি নিজের মধ্যে সেই মৃত্যুর মত অনুভূতি পাছিনা কেন. 
যদি লেখা না আসে তবে আসবে না এরকম  মনে হচ্ছে কেন.
তবে কী আমি লেখার সেই নাছোরবান্দা ভগবানের কাছ থেকে সরে এসেছি?
একবার আমার যাওয়ার কথা ছিল বর্ধমান.
আমি একটা স্টেশন-এ এসে নেমে পড়েছিলাম
আমার আর কোথাও যাওয়ার ইচ্ছে  হয়নি.
আমি অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ কাজ ফেলে সেই স্টেশন-এর চারদিক দেখলাম. বিভিন্ন জায়গায় ঘুরলাম. কাছাকাছি একটা ভাতের হোটেলে ভাত খেলাম.
আর সম্পূর্ণ ভুলে গেলাম বর্ধমানের কাজটির কথা.
কোথায় যাওয়ার কথা ছিল আর কীভাবে দিনটা শেষ হলো.
জীবনতাও কী এরকম ভাবে চলছে?
আমি খুব মাঝপথে নেমে গেছি অমিতাভ, এখানে এখন রাত, এখানে এখন খুব রাত. 
লিখেছিলেন কবি বিশ্বদেব মুখোপাধ্যায়. 
অসামান্য কবি একজন.
তাঁর পাইকপাড়ার বাড়িতে অনেক গভীর আড্ডা হত. 
অনেকদিন জানা তাঁর কাছে. 
তাঁর বাড়ির সামনে একটা অসামান্য গাছ আছে. আর বারান্দাটা এমন ভাবে, যে গাছের পাতাগুলো   তাঁর বারান্দায় এসে পড়ে.
 কিছু ভেবে জীবনটা কাটেনি আমার 
কিছু ভেবে পরিকল্পনা করে বাঁচিনি আমি. 
আর এই কিছু না ভেবে ভেবে আমার জীবনে কিছু করতেও পারিনি আমি.
কিন্তু কী-ই বা করা যেত!
সত্যি যদি ভালো কিছু লিখতে না পারলাম, তো বেঁচে থেকে লাভ কি?
এই কথাটা আমি আমার কাছের লোকেদের বোঝাতে পারিনি.
আমার বাবার কথা মত সফল ভাবে ব্যর্থ হওয়ার চেয়ে ব্যর্থ ভাবে সফল হওয়া ভালো. 
কিন্তু তাও যদি না হই ক্ষতি কী?
এই যে আমি জন্মেছি, এই পৃথিবীটাকে দেখতে পাচ্ছি, এটাই তো অনেক. একদিন এই পৃথিবীটাকে আমি দেখতে পাব না. তখন কোথায় বিজ্ঞাপন, কোথায় লেখা, কোথায় খ্যাতি ! কোথায় অপমান, কোথায় হিংসা, কোথায় ভালবাসা!
আমার লেখা কি তখন পৃথিবীটাকে দেখবে?
দুম করে মনে পড়ে গেল রবীন্দ্রনাথ এর ওই গান : দাঁড়িয়ে আছ তুমি আমার গানের ওপারে/ আমার সুরগুলি পায় চরণ আমি পাই নে  তোমারে.
এই তুমি কী সময়?
সময় যখন কবিতাকে পড়ে, কবিতাও কি সময় কে পড়ে? 
(ক্রমশ)



Comments

  1. এই লেখাটা, বিশেষ করে , মনকে তীব্রভাবে ছুঁয়ে গেল ।ব্যক্তিগত গদ্য সবসময়ই পড়তে ভাল লাগে, একজন স্পর্শকাতর মানুষের মন-পড়তে-পারা যেমন একটা হঠাৎ-পেয়ে-যাওয়া সৌভাগ্যের মতো ব্যাপার ! কিন্তু সেই ব্যক্তিগততে যখন নির্বিশেষের পরশ লাগে, তখন তা আশ্চর্য একটা সিদ্ধিতে গিয়ে পৌঁছয় !

    ReplyDelete

Post a Comment