এলোমেলো আমি-১৭


এলোমেলো আমি-১৭

আমার আগের এলোমেলো লেখাটা নিয়ে আমি ভাবছিলাম. কী আজেবাজে সব লিখেছি. কোনো মানে নেই. সত্যি কোনো মানে নেই. প্রায় মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছি আমি. আমার এসব ভাবা উচিত না. কে কোথায় লেখা ছাপলো বা ছাপলো না তাতে আর এতে এ বয়সে এসে আর কি এসে যায়! সত্যি তো আমার এতগুলো বই. লোকে যদি পরে তবে সময়ের কাছে থাকবে. আর সময়ের কাছে যদি না থাকার হয়, তো থাকবে না. এতদিন কবিতা লিখে তো আর আমার নতুন করে কিছু প্রমান করার নেই. আর আমি কোনো জায়গাতেই ঠিক সামাজিক নই. হয়ত কোনদিন হতেও পারব না. এই সামাজিক না হবার বৈশিষ্ট আমার সেই ছোটবেলা থেকে. কোনো বিয়ে বাড়িতে বা অনুষ্ঠানে আমি যেতাম না. ভিড়ের মধ্যে আমার খুব মানসিক কষ্ট হত. ছোটবেলাতে আমায় কোথাও বেড়াতে যেতে চাইলে সে আলাদা কথা. আর আমি তো কোনদিনই সমমনস্ক মানুষদের সঙ্গে ছাড়া কথা বলতেই পারি না. আমার বইয়ের পরেও এনিয়ে অশান্তি কম হয়নি. এবং সেই অনুষ্ঠানে না যাবার অজুহাতে আমি অনেক মিথ্যেও বলেছি. কিছুই করিনি হয়ত. তখন হয়ত বারিস্তায় বসে কফি খেয়ে সময় কাটিয়ে বাড়ি ফিরেছি.বলেছি প্রচুর চাপে ছিলাম. আমার এসব মিথ্যে গুলোর জন্য আরো গার্গী আমাকে ছেড়ে চলে যায়. 
ভাবনার এলোমেলো এই ঘুরে বেরানোতে কার কি মনে হচ্ছে জানি না. আমি হঠাত আজ মৃত্যু নিয়ে একটু বেশি ভাবছিলাম. দুপুরে. এই যে আমি এখন লিখছি আমার মনে পড়ছে অনেক কিছুই, অনেক অপমান , অনেক যন্ত্রনা, অনেক একা একা বৃষ্টির মধ্তে কেঁদে ওঠাগুলো. কিন্তু আমি আসলে কি নিয়ে ভাবছি! সেই তো আগেরটাতে আমি কবি হবার কথায় লিখলাম. কিন্তু কবিতা লেখার কোনো কথা তো বললাম না. আমি এখন লিখতে পারছি না. এটা আমার কাছে ভয়ানক বাস্তব. কিন্তু এর সঙ্গে কারোর আমাকে অপছন্দ করার কোনো কারণ নেই. আমি এতটা ইম্পর্টান্ট নই. হবার কথাও না. আমার লেখা পড়ে কারোর আমার প্রতি সহানুভূতি আসুক তা তো আমি চাইছি না. আমি চাইছি আমার মনে আসা কথাগুলো যত নগ্ন হোক না কেন তা আমার ভাবনার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বলে যাওয়ার. 
আসলে এই জীবনটা সত্যি বার্গম্যান এর সেভেন্থ সিল এর মত. মৃত্যুর সঙ্গে দাবা খেলছি আমরা. পিঠে চাবুক পড়ছে অপমানের. দু:খের. কিন্তু এই দাবার চাল দেওয়াতে কোনো বাধা নেই. কারণ এই চাল দেওয়াটা তো আমার মননের মধ্যে ঘটছে. আমি আজ দুপুরবেলাতে একটা অসাধারণ ডকুমেন্টারি দেখলাম. কচ্ছপদের নিয়ে. একটি কচ্ছপ কত প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে বেঁচে শেষ পর্যন্ত হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে যায় এমন এক জায়গায় যাতে সে শান্তিতে ডিম পাড়তে পারে! তার পর ডিম পেরে সে আবার চলে যায় অনির্দিষ্ট জায়গায়. এই যে কয়েকহাজার মাইল অতিক্রম করে সমুদ্রের মধ্যে দিয়ে জন্মের পর থেকেই এতেই তার জীবনের সার্থূকতা. কত সহজেই না মেনে নিয়েছে কচ্ছপের যে অভিযাত্রাটাই জীবন. কয়েক লক্ষ্ বছর  ধরে তার জিনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা রাস্তাটা তার কাছে চেনা. তার অবচেতন মনের মধ্যে আছে এই অভিযাত্রার রাস্তা. যেহেতু প্রকৃতির মধ্যেই সে রয়েছে আমার মনে হয় এ কারণে প্রকৃতি তাকে তার অবচেতনের সঙ্গে সচেতন মনের এক প্রত্যক্ষ যোগাযোগ করে দিয়েছে এমন ভাবে যে সে জানে কখন কোথায় তাকে কি করতে হবে! 
মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির যোগাযোগ সম্ভবত অনেক ক্ষীন হয়ে আসছে. যত ক্ষীন হয়ে আসছে, তত মানুষের তার অবচেতনের সঙ্গে সচেতন মনের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে আসছে. অনেক চেষ্টা করে সেই অবচেতনের জার্নির কাছে পৌছতে হয়, অথচ তাকে ধরে রাখাও যায় না. এই খানে এসেই আমার মনে হয় আবহমান অবচেতনা একটি পাখির মত হলেও অনেকটা ফিনিক্স এর মতন বটে. 
কিন্তু এই ফিনিক্স এর উঠে পরাটা অনেক পর্দার আড়ালে চলে গেছে এখন. তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আমাদের মন্থরতাহীনতা. যুক্ত হয়েছে এক অদ্ভুত শহর. এক অশ্লীল নাগরিকতা. এই কলকাতা শহরটাকে দেখতে দেখতে আমার মনে হয় এই শহরটা পুরোটাই এখন বেশ্যা হয়ে গেছে. সন্ধ্যে হলেই এই শহর নানা রং মেখে আলো মেখে দাঁড়িয়ে পড়ে. সারাদিন তার প্রস্তুতি চলে. সে যেন পরখ করে নেই, সে যেন তখন ভোগ করে. আর লালসার গন্ধ ঘিরে থাকে এই শহরে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত. শহরের সঙ্গে সঙ্গে শহর বাসীরাও হয়ে গেছে যন্ত্রমানবের মত. এই শহরটা কে যদি রিফর্মাট করা যেত!
আমার ভিতরে আরও একটু অভাব বোধ আছে! তা হলো আমার নিজের প্রাণ এর. কি আশ্চর্য বলুন তো আমি মানুষের সঙ্গে সহজ ভাবে মিশতে পারছি না! শুধু তাই নয় আমার মনে হচ্ছে আমি এই শহরের এক্কেবারে বাইরের লোক. অথচ এই শহর জানে আমার প্রথম সব কিছু!
লক্ষ্য লক্ষ্য আলোক বছর দূরের সব নক্ষত্র গুলো আমাকে ভাবে. এই অন্ধকারের মধ্যে কতদূর! এমন একটা বিন্দু আছে যেখানে এখনো পর্যন্ত বিগ ব্যাং এর বিস্ফোরণ গিয়ে পৌছোয়নি! তো সেই জায়গাটি আমার কাছে কি? আমার অতীত না আমার ভবিষ্যত? সেই বিন্দুটার কাছে আমি অতীত. কারণ বিগ ব্যাং সেখানে ঘটেইনি. আবার আমি প্রসারিত হতে হতে, আমার মহাবিশ্ব প্রসারিত হতে হতে সেই বিন্দুটির দিকেই চলেছে যেখানে আজ বিগ ব্যাং এর বিস্ফোরণ গয়ে পৌছোয়নি! তার মানে সেইবিন্দুটি আমার কাছে ভবিষ্যত বটে. তাহলে কি হলো? আমার অতীত এবং ভবিষ্যত সেখানে এক!!!
অর্থাত বর্তমানে দাঁড়িয়ে আমি ভাবতেই পাড়ি, আমার অতীত ভবিষ্যতে আছে আবার আমার ভবিষ্যত আমার অতীতেও ঘটে গেছে. আমি যেখানে আছি তা একটি বর্তমান মাত্র, আমার রিয়ালিজম যার কোনো মানে নেই. মৃত্যুর পর আমাদের চেতনা কোথায় যায় তা কি কেউ জানে! একটা কথা চেতনা বলে আদৌ কিছু আছে কি না কি আমরা নিরাপদ অনুভব করার জন্য চেতনার কথা ভাবছি মাত্র!
যদি সত্যি থাকে আর যদি আমার নতুন করে কিছু আবিষ্কার করার না থাকেম, তাহলে আমার অতীত, ভবিষ্যত, আমার বর্তমান সবই আমার সঙ্গে এই মুহুর্তে বিরাজ করছে. আমার অক্ষমতা যে আমি সেগুলিকে দেখতে পাচ্ছি না. আর দেখতে পাবই বা কিভাবে! দুটো একসঙ্গে ঘটছে এটা যেমন ঠিক তেমনি এই সময়গুলি একে অপরকে তৈরিকরছে, ধংস করছে!
তারা একই সঙ্গে দেখা দিতে পারে না. কিন্তু তারা একই সঙ্গে রয়েছে! সত্যি কি মজার জগত তাই না!
আচ্ছা মেডুসার চোখ কাব্যগ্রন্থটি কি পড়ছেন কেউ?
হঠাত এ কথা মনে হলো কেন?
আমার এমন হঠাত হঠাত সব মনে হয়. যেমন দরজাটা আধ খোলা ছিল., আমি ভাবছিলাম দরজাটাকে বন্ধ করে দিলে কেমন হয়! তার পর ভাবলাম সব দরজা কি এমন আধ খোলায় থাকে? অদ্ভুত কিছু বিষয় আমার মনকে এলোমেলো করে দেয়. বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা কেউ. বিকেলের গাছেদের মাথায় কলকাকলি করা পাখিদের ব্যস্ততা, নি:শব্দে বসে থাকা বুড়ো, সন্ধেবেলার অন্ধ গলি, এবড়োখেবড়ো ছুটে আসা শব্দ, এরকম নানা কিছু. মাঝেমাঝে আমার কানে সাইলেন্সার লেগে যায়, আমি ভিড়ের মধ্যে মানুষের মুখ নাড়া দেখি. অসংখ্য মানুষ মুখ নেড়ে চলে, তাদের বিচিত্র অঙ্গভঙ্গি...আমাকে কেমন বিষন্ন করে দেয়. আমি যে সময়টায় বসবাস করছি, এই সময়ে মানুষের কোনকিছুতেই আর মধুর রস নেই. সব কিছুতেই আছে তীব্র এক তির্যক রস. 
  আমার আজ এখন মনটা একটু ভালো. সকালে কী অদ্ভুত ভাবে লেখা নিয়ে হীনমন্যতায় ভুগছিলাম! ভাবছিলাম আমি সকলের কাছ থেকে মুছে যাব, এটাই নীতি. হয়ত এটাই আমার নীতি. কিন্তু আজ আমি দুটো নতুন কবিতা লিখেছি অনেক দিন পর. এটা যে কী আনন্দের তা বলে বোঝানো সম্ভব নয়. 
আর এই বলে না বোঝাতে পারা অনুভূতিগুলোই আমাকে নিয়ে যায় নতুন কোনো এক অঞ্চলে. আমার অনুভুতিপ্রদেশে. আমি যখন ভেবেই নিয়েছিলাম আমি আর বাঁচব না, তখন থেকে আমার ভিতরে যে নির্বিকার মন জন্ম নিয়েছে, তা যেন হঠাত হারিয়ে গিয়েছিল. কী বা হবে যদি কবিতা না ছাপা হয় কোথাও! আর ছাপা তাপ নিয়ে ভাববার বয়স পেরিয়ে গেছে! 
এমন কিছু লিখতে হবে যাতে পাঠক বুঝতে পারেন জগত কে এভাবেও দেখা যায়!
আমার মনে হয় জীবনানন্দ এই জায়গাতেই ছাপিয়ে গেছেন সকলকে, যে উনি আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখালেন দক্ষ এভাবেও দেখা যায়!
সকলে যেমন বাঁচে তেমন ভাবে আমি বাঁচার জন্য আসিনি.
নিজেকে রিজেক্ট করার আগে আমি কিছু জিনিস জানতে চাই.
আমার ইন্দ্রিয় কে জানতে চাই.
আমার মনের ভিতরে থাকা অনুভুতিজগতকে আরেকবার পরখ করে দেখতে চাই, যে সে আগের মত বেজে উঠছে কি না!
আমার খুব আনন্দ হচ্ছে!
হঠাত মন খুব ভালো হয়ে গেছে!
অন্তত আমি তো স্বাধীন ভাবে ভাবতে পারছি! আমার ভাবনাকে তো কেউ কিনে নিতে পারেনি. আমি তো বাধ্য হয়ে কোনো এক ভাবে ভাবতে পারছি না. আমি তো পারছি নানারকম ভাবে ভাবতে. যেদিন এটাও বন্ধ হয়ে যাবে সেদিন আর আমার বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই.
আমার আগের পোস্ট এ যদি কেউ আহত হয়ে থাকেন তবে আমি ক্ষমা চাইছি. 
কারণ আপনারা অনেক কিছু বোঝেন. আপনাদের অনেক কিছু মাথায় রাখতে হয়. স্বাভাবিক.
আমার সে দায় নেই.
আমি থোরাই কেয়ার করি!
আমার কাছে আমার আকাশ আছে, আমার কাছে আমার মৃত্যু আছে, আমার কাছে আমার নিজের সঙ্গে কথা বলা আছে, আমার সঙ্গে আমার ভাবনা জগত আছে.
যারা বা যা যা ছেড়ে গেছে, তা সম্ভবত যাবার কথাই ছিল.
খুব ভালোবাসলেও নিজের অক্ষমতাগুলোকে, নিজের ব্যার্থতাগুলোকে তো ভুলে থাকা উচিত নয়.
আর কে বলতে পারে, ব্যার্থভাবে সফল্ততার দিকে আমি যাচ্ছি কিনা!
কাল সকাল থেকে আমার পারফরমার হবার পরীক্ষা আবার.
কিন্তু ভিতরে তো সে রয়েছে, সে দেখতে জানে.
শুধু তার চোখদুটো আরো খুলে যাক.
দৃশ্যের মধ্যে দৃশ্যকে, ভাবনার মধ্যে ভাবনাকে, ভাষার মধ্যে ভাষাকে, কথার মধ্যে কথাকে সে দেখুক. আরও ভালো ভাবে গন্ধ পাক সে.
গন্ধগুলোকে নিয়ে সে নীরবতায় কথার মধ্যে ডুবে যাক.
যা এতদিনেও আমি রপ্ত করতে পারিনি, অর্থাত নিজের মধ্যে নিজেকে দেখে তার সঙ্গে কথা বলা, তা সে করুক.
আমার কেন জানি না খুব পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল-er katha মনে পড়ছে, আমার পার্থদার কাছে যেতে ইচ্ছে করছে.
দেখি.
(ক্রমশ)

Comments

  1. চমৎকার লাগল। লিখা গুলো যেন লুপ হয়ে মনের ভিতর ঘুরছে।

    ReplyDelete
  2. চমৎকার লিখা।

    ReplyDelete

Post a Comment