এলোমেলো আমি-১৯


এলোমেলো আমি-১৯
চারিদিকে পুজোর বাজনা. প্যান্ডেল, ঠাকুর. আলো, প্রতিমা. ফুচকা. জ্যাম. আজ ষষ্ঠী. ভাবনাগুলো ঘুরে বেড়াচ্ছে মাথার ভিতরে. কয়েকদিন চুপ করে ছিলাম. কারণ নিজেই আমার লেখাগুলো পড়ে মনে হচ্ছিল আমি কোথাও হয়ত বা আমার কাছ থেকে সরে যাচ্ছি. নিজের কাছে ফিরে আসাটাই মনে হয় আমার বোধন. কোনদিনই খুব একটা ধার্মিক ছিলাম না. আমার কাছে ঈশ্বর মানে এই মহাজগত. সময়. কি বিশাল এই আকাশ! কী বিস্ময় এই জীবন! কী নির্মোহ এই মৃত্যু! সত্যি কারোর জন্য কোথাও কোনো কিছু আটকে থাকে না. কেউ বিস্মৃত-ও হয় না. কেউ খুব একটা চিরস্থায়িও হয় না. আমার লেখাগুলো পড়ে যারা আমাকে বলেছেন আমি নিরাশাবাদী, আমি কিন্তু তা নই. আসলে আমাদের সম্পূর্ণ অস্তিত্ব এবং যাপনের মধ্যে নিজেদেরই চোখ ঠার দিয়ে বেঁচে থাকার একটা প্রবণতা আছে. আমি সেই প্রবণতা থেকে বেরিয়ে যেতে চাই. কিন্তু কীভাবে বেরোব? এ ক্ষেত্রে আমাকে ভীষণ ভাবে প্রভাবিত করে জেন ভাবনা এবং বৌদ্ধ ধর্ম. এই ভদ্রলোকের ভাবনা আমাকে আমার জীবনে নির্বিকার থাকতে শেখায়. এবং কোথাও না কোথাও আমরা আমাদের জীবনে এই নীরবতার কাছে যেতে চাই. কিন্তু এই নীরবতার কাছে গেলে ভয়ানক সমস্যা. কারণ মানুষ ভাবতে ভালবাসে না যে জীবনে শূন্যতাই প্রকৃত. যদি তা-ই হয়, তবে কেন আমাদের ভুয়ো জীবনচর্যার মধ্যে কাটাতে হবে? 
আমার স্মৃতি আমার কাছে খুব ভালবাসার. কিন্তু তার মানে এই নয় যে আমার স্মৃতির মধ্যে ডুবে গিয়ে আমি সর্বদাই আমার পিছনে ফিরে যাই. কারণ আমার ফেলে আসা সময়গুলি নিয়ে আমার আক্ষেপ আছে, কিন্তু এর জন্য অন্য কেউ দায়ী নয়, আমি নিজেই দায়ী. ও hayn, এই kodine আমি বেশ কিছু কবিতা লিখেছি. আমি আবার লিখতে পারছি ইটা আমার কাছে বেশ জেগে ওঠার মত ব্যাপার. 
সেদিন নিজের সঙ্গে দেখা হলো আমার পুরনো এক  দিনলিপি  খাতায়. সেখানে একটা অপ্রকাশিত উপন্যাসের খসড়াও করা আছে দেখলাম. মজার ব্যাপার. এর মানে আমার তিনটি উপন্যাস. এ বার ওটাকে লিখে ফেলব. আমি দেখছি আমাকে নিজের মধ্যে ফিরতে হলে কিছুকাল সমস্ত সামাজিকতা থেকে বাইরে যেতে হবে. এই যে নিজের মধ্যে একটা দোকান খুলে বসেছি সেটা ঠিক নয়. 
কবিতা লেখা হচ্ছে কি হচ্ছে না সেটা বিষয় নয়. বিষয় হলো আমি কবিতা লেখার মনের কাছে আছি কিনা. আমি বেশ ভাবলাম. এই একটু আগে ভাবছিলাম. অদ্ভুত ব্যাপার. আমাদের অফিসের সামনে একটা নিম গাছ আছে. গাছটা বেশ দীর্ঘ. একটা গাছ, যার প্রাণ আছে, তার কি মন নেই? মন কি শুধুমাত্রই ব্রেন-এ থাকে? গাছের কাছে এই জগত ঠিক কীরকম?
আমার পক্ষে হয়ত কোনদিনই তা বোঝা সম্ভব হবে না. গাছ উত্তাপ অনুভব করতে পারে. ঝড় বৃষ্টি অনুভব করতে পারে. হাওয়া অনুভব করে. গাছের মন নেই? গাছের দু:খের কথা নেই? নদীর স্রোত, তার ভাষা নেই? তার মন নেই? এলোমেলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পাথর? এসবের মন নেই? এই যে বাড়ি ফিরি একটা রাস্তা দিয়ে, এই রাস্তা আমি আমার মত দেখি, আবার অন্যেরা তাদের মত দেখে. অর্থাত একটি রাস্তাকে সেই রাস্তার উপর দিয়ে যাওয়া অসংখ্য মানুষ তাদের মত করে দেখছে. এই প্রতিটি দেখার মধ্যে আছে তাদের বেড়ে ওঠা, তাদের জীবন, তাদের মন, তাদের অনুভূতিমালা. সেই সমস্ত অনুভূতিমাল এবং অভিজ্ঞতায় তো সত্য. 
অর্থাত আমার দেখার মধ্যে যদি তাদের দেখাগুলোকেও চিনে নিতে না পারি, তাহলে আমার ভাবনায় গলদ রয়েছে. আমার অনুভূতিমালা হওয়া উচিত গাছের শাখা প্রশাখার মত. চাঁদের, সূর্যের আলোর মত, বা ঝম ঝম বৃষ্টির মত. যা সকলের মনের মধ্যে, শরীরের মধ্যে, ইন্দ্রিয়ের মধ্যে ঢুকে যায়. তাহলে
এখান থেকে এই ভাবে ভাবা যায় যে, নিজেকে আবিষ্কার করাটাই ঈশ্বরকে আবিষ্কার করা. এত বেশ মজার. আমি আসলে আমার লেখার মধ্যে দিয়ে অন্য কাউকে না, কেবল নিজেকেই আবিষ্কার করছি. শুধু সেই আবিষ্কার যদি না ছড়িয়ে থাকে, যদি এককেন্দ্রিক হয়, তবে আমি আমাকেও আবিষ্কার করতে পারব না. এখান থেকে যাওয়া যেতে পারে আরো একটি ভাবনায়, আর তা হলো অভিজ্ঞতার ক্ষনস্থায়িত্ত্ব, জীবনে নানা তৈরী করে দেওয়া ভাবনাকে অস্বীকার করতে পারার শিক্ষা এবং প্রশ্ন করতে পারার নির্মোহ অস্তিত্ব. প্রশ্ন করব কিন্তু তর্কের জন্য নয়. প্রশ্ন করব জানার জন্য-ও নয়. প্রশ্ন করব আমার অনুভূতির ক্যানভাসে কিছু ছবি আঁকব বলে. 
অ-সত্য যেমন সত্যের বিপরীত নয়, তেমনি অ-স্বীকার স্বীকারের বিপরীত নয়. 
আমরা কিছু প্রান্তবিন্দু স্থির  করি, কিন্তু সেগুলি আসলে আমাদের ভুল দেখাগুলোকেই চিন্হিত করে বারবার. যেমন এই মহাজগতের কোনো কেন্দ্র নেই, তাই সমস্ত বিন্দুকেই কেন্দ্র ভাবা যায়, তেমনি কোনো ভাবনার কোন কেন্দ্র থাকতে পারে না, কোনো প্রান্তবিন্দু থাকতে পারে না. যা থাকতে পারে তা হলো সম্ভাব্যতা. 
এই লাঞ্চ করার জন্য উঠতে হবে. আমি ভাবছিলাম এই লেখাটিকে কীভাবে সেভ করি! যদি লোডশেডিং হয়ে যায়? তার পর মনে হলো কী বা হবে? আমার এই লিখে রাখাটা যে হচ্ছে, তা তো ভাবনাগুলো আমার মাথাতেই আছে তাই. আমি তো এই সব ভাবনাগুলো লিখে রেখে নিজের ভাবনাগুলোকে নিয়েই একটু নড়াচড়া করতে চাইছি. এর বেশি তো কিছু না. এগুলো কিছু লেখায় না. 
এই যেমন চারিদিকে খুব আনন্দ. আমাদের গোটা অফিস বেরিয়ে গেল পুজো পরিক্রমায়. ব্যাপারটা দারুন. কিন্তু আমার ভালো লাগছে আমার নিজের মনের মধ্যে একা থাকতে. আমি ঠিক দলবেঁধে আনন্দ করতে পারছি না. এ কি কোনো দু:খের কারণে? একদমই না. বাইরের দুপুরের রোদ্দুরের মধ্যে কোনো একটা শব্দ আছে. চারদিকের এই প্রচুর শব্দের মধ্যে কোনো একটা জায়গায় নিস্তব্ধতা আছে. আর সেই নিস্তব্ধতার মধ্যে প্রকৃতি কথা বলছে. সময় কথা বলছে. কিন্তু কি বলছে? 
ভিড়ের হৃদয় জানাটা যেমন খুব দরকার তেমনি দরকার নিজের মধ্যে থাকা চতুর্দিক কে জানার এবং চতুর্দিকের মধ্যে থাকা নিজেকে জানার. 
খুব ওপর ওপর কথা বলছি কি? 
কেন এমন আমার হয় কে জানে, যত এই উত্সবের দিন আসে, তত আমার মন বিষাদে আক্রান্ত হয়ে যায়. 
চারিদিকে এক চমক বাজির পৃথিবী. এমন কী এখন কবিতাগুলিতেও শুধু চমক. আমাদের কথা আর ভাবনা কী ক্রমশ ফুরিয়ে আসছে? আমাদের কি সত্যি পিন ফুটিয়ে চমকাতে হবে? পাঠক কি নীরবতার ভাষাতে বন্ধুর মত ছুয়ে থাকবেন না কবিতাগুলিকে? 
এই কয়েকদিন আগে মারা গেলেন কবি শৈলেশ্বর ঘোষ. কী অসাধারণ কবি! 
কবির কি মৃত্যু হয়? 
তারা কি সত্যি ভাস্করদার কথা মত কবিতা লিখে পাঠিয়ে দেয় পৃথিবীতে?
কে আমার কবিতা লেখে আমি জানি না. শুধু খুব বিশ্বাস হয় যে কবিতা লেখে আমার হয়ে সে কিছুতেই আমি নয়. সে অন্য কেউ. সে মাঝেমাঝে আসে. তার মাঝে মাঝে আসাটাই ভালো, অথবা সম্পূর্ণ ঝাঁপিয়ে পড়া ভালো. বিনয় দা যেমন. তাঁকে কবিতা অধিকার করেছিল. তিনি বলেছিলেন কবিতা লেখ. পুঁতে দাও মাটিতে. সেখান থেকে গাছ হলে জানবে কবিতাগুলি হয়েছে! 
সত্যি বিনয় দা. অভিজ্ঞতাগুলি ক্রমে সিক্ত গিরিখাতের মতন.
(ক্রমশ)

Comments