এলোমেলো আমি -১৮
এলোমেলো আমি -১৮
কিন্তু এই সময় নিয়ে সমস্যার অন্ত নেই. এই সময় চায় না আমরা মন্থর ভাবে পর্যবেক্ষণ করি. চায় আমরা দৌড়াতে থাকি. চায় আমাদের মগজের মধ্যে নিস্তব্ধ ভাবে মন্থরতাকে পর্যবেক্ষণ করার আমাদের ভিতরে থাকুক. সব সময় কে যেন হুইসিল মুখে নিয়ে বাজিই চলেছে. আর আমরা অনেকটা দুরে এসে আবার একটু হাঁফ ছাড়তে না ছাড়তেই আবার দেখছি ছুটে যাবার নির্দেশ. থামলেই মুশকিল. সাম্প্রতিক আধুনিকতার এ এক সমস্যা. এই যুগ, এই তড়িত গতিতে ছুটে চলার সঙ্গে নিজেকে সামঞ্জস্য বজায় রেখে চলতে না পারলেই তুমি পিছিয়ে পর্বে আর পিছিয়ে পড়লেই সমস্যা. তুমি তখন স্রেফ মিলিয়ে যাবে. তোমাকে কেউ মনেও রাখবে না. কিন্তু এই অবস্থার সঙ্গে নিজেকে খাপ খাই নিতে নিতে এমন এক সময় আসবে, যখন মানুষ আর পর্যবেক্ষণের মন্থরতার সঙ্গে তাল মেলাতেই পারবে না. তাল মেলাতে যদি হয়ই, তাহলে কেন এমন কোনো বিষয়ের সঙ্গে তাল মেলাতে হবে, যা ক্রমশ মানুষকে মননহীন করে তোলে? মাথার ভিতরে তখন কেবলি এক মেশিনদেবতা. অভিযোজনের বিজ্ঞান যদি মনে রাখি, তাহলে, আমাদের মস্তিস্ক হয়ত কেবলি গতির সঙ্গে তাল মেলাতে মেলাতে ভুলে যাবে মন্থর ভাবে পর্যবেক্ষণের বিষয়টি. অভিযোজনের সুত্র ধরেই বলা যায়, যা আছে, তারই নানা প্রযুক্তিগত রূপ আবিষ্কার , যা বলা হয়েছে, তারই বিভিন্ন রূপান্তর লিখতে, ভাবতে এবং প্রয়োগ করতে করতে আমরা ভুলে যাব নতুন কিছু খুঁজে পাবার জন্য প্রয়োজন আমাদের স্থিরতা, আমাদের শান্ত রস, আমাদের ধৈর্য, আমাদের পর্যবেক্ষণ.
জীবনকে আসতে ভেসে যেতে দেওয়ার মধ্যে আছে জীবনের আনন্দ. কারণ এই আসতে ভেসে যেতে দিতে পারলে তবেই অনুভব করা যায় প্রকৃতির মধ্যে এমন কোনো সুত্র আছে, যা এখনো আমার অজানা, কিন্তু যাকে আমি ছুঁয়ে ফেলতে পারব. জানতে পারব. যদি জানতে পারি, তবেই না তাকে লেখা যায়. তবেই না তার মধ্যে থেকে প্রকৃতির মধ্যে থাকা নতুন কোনো বীজ কে খুঁজে পাওয়া যায়! কিন্তু আমার সময় তো আমাকে বলছে তুমি পর্যবেক্ষণের মধ্যে যেও না. তোমাকে এক্ষুনি একটা সমাধান বের করতে হবে. সমাধান কারো. যে যত বেশি সমাধান করতে পারবে, সে তত বেশি এই সময়ের সঙ্গে মিশে যেতে পারবে, তাকে তত এই সময় সমাদর করবে, তা সে যে পেশাতেই থাকুক না কেন, যে কাজ-ই করুক না কেন!
আর এখানেই আমরা পিছিয়ে পড়ছি. আমাদের আগের সময় আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসছে. আমাদের বিদ্রুপ করছে. আমাদের চোখের উপর bheshe বেরিয়ে যাচ্ছে নানা কিছু কিন্তু আমরা কোনো কিছুই ধরতে পারছি না. এরকম একটি সময় আসতে চলেছে.
না আসলেই ভালো.
নিজের মনকে সংহত করার জন্য মন্থরতা প্রয়োজন. মন্থরতা কিন্তু স্থবির হয়ে যাওয়া না. মন্থরতা হলো গাছের পাতার মত. তার ভিতরে রান্না হচ্ছে. অথচ বাইরে থেকে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না. কচি পাতা সবুজ হচ্ছে. মাঝখানের জার্নিটা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না. কিন্তু হচ্ছে. এই হওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ. 'হওয়া এবং না হওয়া '- পারস্পরিক এবং আপেক্ষিক.
আমি যখন কিছু করছি না তখন আমি অনেক কিছু করে যাচ্ছি. মুশকিল হচ্ছে এই অনেক কিছু করে যাওয়াটা সঙ্গে সঙ্গে ধরা পড়ছে না. দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না. নিজের মনের ভিতরে যে রান্নাঘর তার মধ্যে ঢুকে পড়ছে শহর, গ্রাম, মাঠ, ঘর-গৃহস্থালি, আকাশ, নানা রকম শব্দ, গন্ধ সব. আর এ সব মনের মধ্যে ঢুকে পড়ে জন্ম দিছে বোধের. সে বোধ কখনো সুর, কখনো কাব্য, কখনো নাট্য, কখনো দৃশ্যের জন্ম দিছে. ' আমরা জানি মরে আজ, তবু কেবলি দৃশ্যের জন্ম হয়'. সে কি এমনি এমনি?
এই বার মনে হচ্ছে আমি ভাবনার ভিতরে ঢুকতে পারছি.
অথবা পারছি না.
চেষ্টা করছি.
যেকোনো দৃশ্যের দিকে এক নিমেষে তাকিয়ে থাকলে অনেক কিছু টের পাওয়া যায়. সূক্ষতা গুলোকে জানতে পারা যায়. সে চোখের দিকে তাকিয়ে থাকাটা অনেক দিন হয় না আমার. আমি আগে যেকোনো মানুষের চোখ দেখতাম.
মনে আছে এরকম একজনের চোখ দেখে মনে হচ্ছিল আমি নিজেকে দেখছি.
লেখা হয়েছিল একটি কবিতা. সে এক খুব মন্থর কবিতা.
কবিতাটির নাম আলেখ্য.
তোমার সহজ মুখ বৃষ্টিপতনের শব্দে ভেজা
বহুযুগ ধরে যেন তাকিয়ে রয়েছে
ফুলের নিদ্রিত স্বপ্ন যেমন ফুলের থেকে দূরে মিশে যায়
পরাগরেণুর মর্মে, আমি তার বেদনায় বিঁধে
তোমার চোখের মত, আমারই মূর্তির দিকে
তাকিয়ে রয়েছি.
এই কবিতাটি আমার কাছে আসেনি. এর জন্য আমাকে বহ্হুদিন ধরে অনুভব করতে হয়েছে কেউ আমার দিকে তাকিয়ে থাকলে সে কি দেখে, কীভাবে দেখছে, এবং তার দেখার মধ্যে আমি কীভাবে আমাকেই দেখছি সেটি অনুভব করা. লেখাটা উতরেছে কিনা আমার জানা নেই. হয়ত সময়ের নিয়মে হারিয়ে যাবে. কিন্তু আমার কাছে এই লেখাটি লেখার সময়ে যে শারীরিক ও মানসিক অনুভূতি জগত জেগে উঠেছিল, সেই সময়ের অভিজ্ঞতাটি গুরুত্বপূর্ণ. কারণ লেখাটি লেখার পর আমি মানুষ হিসেবে পাল্টে গিয়েছিলাম.
আমার মনে হয় কবিতা বা লেখা বা যে কোনো শিল্প মাধ্যম মানুষকে এভাবে নিজেকে আবিষ্কার করতে শেখায়.
কবিতা লিখে যদি আমার নিজের শরীর-মন'এ কিছুই না হয়, আমার যদি তার পরের মুহুর্তগুলো অন্য ভাবে না কাটে, যদি না অন্য চোখে আমি জীবনটাকে দেখতে পারি, তাহলে কবিতা লিখে আমার হলটা কী!
একটা জায়গায় যেমন আমি কবিতাকে লিখছি, তখন কবিতাও আমাকে লিখছে. আমার পরবর্তী আমি-দের লিখছে. একটা বই মানে কবি- বা লেখকের মৃত্যু ও পুনর্জন্ম.
এই পুনর্জন্ম যদি বন্ধ হয়ে যায় তাহলে মৃত্যুর কোনো মানে নেই আবার মৃত্যু যদি পুনর্জন্ম না এনে দিতে পারে, তাহলে লেখার মানে নেই. অর্থাত একটা কবিতা বা লেখা বা আঁকা আমাদের মোচন করে বাস্তব থেকে আরো গভীর মনের বাস্তবে. সেখানে আমরা আমাদের মনের মধ্যে থাকা আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারি. সহাবস্থান করতে পারি. কথোপকথন করতে পারি.
উন্মাদের পাঠক্রম তৈরী হয় জীবনে.
কিন্তু এই উন্মাদের পাঠক্রম শীতল পাথরের থেকে ভালো. এই ভালোটুকুকে আরও ভালো ভাবে জানতে গেলে দরকার পর্যবেক্ষণ.
দরকার সমস্ত ছাঁচ থেকে নিজেকে বের করে আনা.
ছাঁচে আমরা নিরাপদ থাকি. কিন্তু কবিতা লেখা অন্তত আমার কাছে সরু কার্নিশের উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া. নিজেকে খাদের কাছে নিয়ে না গেলে কী করে পারব পর্যবেক্ষণ করতে?
আমার সময়ের সঙ্গে আমাকে যদি নিয়ত মানিয়েই নিতে হয়, তাহলে জীবন-লেখা-শিল্প- সবই সার্থক পথে আমাকে নিয়ে যাবে. ব্যর্থতার পথে নিয়ে যাবে না যার জন্য আমি বার বার পর্যবেক্ষণ করব আমি যা দেখছি তাকে!
তার মানে কোথাও আমাকে নিজের থেকে এবং নিজের সময়ের থেকেও বেরোতে হচ্ছে. নিজের ছাঁচ থেকে বেরোতে হচ্ছে.
আর তা নিরাপদ নয়
নিরাপদ থেকে বেঁচে লাভ কি আছে?
মহাবিশ্বের সঙ্গে সঙ্গে প্রতি মুহুর্তে কয়েক হাজার মাইল পাড়ি দিচ্ছি নিয়ত.
দেখব না?
(ক্রমশ)
তোমার সহজ মুখ বৃষ্টিপতনের শব্দে ভেজা
ReplyDeleteবহুযুগ ধরে যেন তাকিয়ে রয়েছে
ফুলের নিদ্রিত স্বপ্ন যেমন ফুলের থেকে দূরে মিশে যায়
পরাগরেণুর মর্মে, আমি তার বেদনায় বিঁধে
তোমার চোখের মত, আমারই মূর্তির দিকে
তাকিয়ে রয়েছি.
দুর্দান্ত লাগল।