এলোমেলো আমি-১৩


এলোমেলো আমি-১৩ 

এই কদিন অফিসে যা চাপ যাচ্ছে, যে আমি একবিন্দুও লিখতে পারিনি. হাজার রকম লেখা হাজার রকম কথা. অসংখ্য বিষয়. সব মিলিয়ে এক যাচ্ছেতাই ব্যাপার. হাঁ, কথা হচ্ছিল অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত কে নিয়ে. তার পর যেন কোথায় কোথায় চলে গেছিলাম. আজ যখন বাড়ি ফিরছি তখন উবুশ্রান্ত বৃষ্টি পড়ছে. চারিদিকে জল. এই জলের দিকে তাকালেই আমার মনে পরে যায় ছোটবেলার কথা. আমি হিন্দু স্কুল-এ পড়তাম. মর্নিং-এ যখন পড়তাম, সেই দিন গুলো ছিল দারুন. বাবার সঙ্গে এল থ্রী সি তে করে সক্কাল সাড়ে পাঁচটার সময়ে বেরোতাম, আর পৌছতাম সকাল ছটার মধ্যে. একটু দেরী হলেই কেস. আমাকে খুব ভালবাসতেন ঝর্নাদি, অন্জলিদী, শিববাবু. অঙ্কে আর বাংলায় খুব ভালো ছিলাম বলে আমাকে সবাই খুব ভালবাসতেন. আমরা সবাই মিলে একটা দেয়াল পত্রিকা করতাম. মনে আছে আমি একবার দেয়াল পত্রিকায় সদ্য পড়া ( কী পাকাই না ছিলাম) আরণ্যক নিয়ে আমার গুরুগম্ভীর রচনা লিখে খুব বকুনি খেয়েছিলাম. কারণ ওই সময়ে ৮ বছরের আমার চোখে আরণ্যক ছিল একটা রূপকথা. লিখেছিলাম এমন সুন্দর রূপকথা আমি পড়িনি আগে. হাহাহাহা. পরে বুঝেছি বকুনি খাবার কারণ. তবে আরণ্যক কি রূপের কথায় নয়? এক অনির্বচনীয় রূপের কথায় তো বটে. বিভূতিভূষণ নিয়ে যত পরেছি তত আশ্চর্য হয়েছি বারবার. আচ্ছা বিভূতিভূষণ কে যদি  বাংলার অন্যতম একজন আধুনিক কবি  বলি তাতে কি কেউ আপত্তি করবেন? জল জমার কথা হচ্ছিল. তো কলেজ স্ট্রিট-এ তো খুব জল জমে. একবার মনে আছে প্রচুর জল আর বাবা আমাকে কাঁধে করে স্কুল-এ পৌছে দিছে. আমার এখনো সেই ছবিটা ভাসে. একবার স্কুল পালিয়ে সিনেমা দেখতে গেছি. তখন সদ্য আমার ঠাকুমা মারা গেছেন. মা-বাবা বেরিয়েছিল কথাও. আমার তো তা জানার কথা না. আমি আর আমার বন্ধু ওঙ্কার রাধার সামনে দাঁড়িয়ে সিগারেট  খাচ্ছি. এমন সময় হুঙ্কার. দেখি বাবা আর মা টাক্সি থেকে ডাকছে. ব্যাস হয়ে গেল. বাবা আমাকে কিছু বলেনি. মা প্রচুর ঝেড়েছিল. আর বাবা মারা যাবার কয়েকদিন আগে টেস্ট পরীক্ষার রেযুল্ত বেরোনোর দিন সে তো এক দারুন ব্যাপার. আমি তো কফি হাউস এর তিনতলার বারান্দাতে দাঁড়িয়ে মনের সুখে সিগারেট খাচ্ছি. থার্ড হয়েছিলাম. এমন সময়ে একজন ইশারায় আমাকে জানালো নিচ থেকে কেউ আমাকে নাকি ডাকছে. ও মা, চেয়ে দেখি বাবা বসে. নীচে গেলাম. বাবা বলল কি খাবি বল. খেলাম. কফিও খেলাম. তার পর বাবা বাবার পকেট থেকে সিগারেট বের করে নিজে ধরালো. আমার দিকে এগিয়ে দিল. আমি তো বললাম খায়না. বাবা বলল না খেলে মারব আর খেলে মারব না. অগত্যা ধরাতে হলো. সেই থেকে বাবার সামনেই সিগারেট খেতাম আর মা চিত্কার করত. এই সুখের দিন বেশিদিন স্থায়ী হলো না. বাবা চলে গেল. 
সে গল্প তো আগেই লিখেছি. তার পর ঘাসের জঙ্গলে পড়ে আছে আমার ব্যাক্তিগত বসন্ত দিনের চটি. কী অসামান্য কবিতা এটা. যেবার প্রথম পড়িএই কবিতাটা, আমি কিছু বুঝিনি, শুধু কিছু একটা মন্ত্রের মত হেঁটে বেড়াচ্ছিল আমার শরীরে. তার পর ধীরে ধীরে কবিতাটিকে আবিষ্কার করি. উত্পল কুমার বসু. বাংলা সাহিত্যের আরেক অসামান্য কবি. কবিতার ভাষাটাকেই পুরো পাল্টে দিলেন,যেমন পাল্টে দিয়েছিলেন শক্তি-প্রনবেন্দু- বিনয়-শঙ্খ- অলোকরঞ্জন. পরের দিকে ভাস্কর, তুষার রায়, তুষার চৌধুরী, মৃদুলদা, রমেন্দ্রকুমার, দেবদাস দা, পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল, গৌতম বসু, রনজিত দাশ, পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল. আমাদের নব্বইয়ের কবিতার প্রথম দিকে অসম্ভব প্রভাব ছিল উত্পল কুমার বসু, বিনয় মজুমদার আর মৃদুলদার. তার পর ধীরে ধীরে নেশার মত ভাস্করদা. সত্যি কথা বলতে কি জয়দার প্রথম ছটি কাব্যগ্রন্থের পর বাকি গুলো তেমন ভাবে টানত না. মনে হত ছন্দ আর সেন্টিমেন্ট এর মিশেল. এখনো অবশ্য তাই-ই মনে হয়. জয়দা নিজেকে একদম পাল্টে ফেললেন সূর্য পড়া ছাই এসে. তার পর থেকে আবার নতুন একটা জার্নি. 
জয়দা অসম্ভব বড় মাপের কবি. বাংলা ভাষাকেও অনেক বদলে দিয়েছেন বলতে গেলে. কিন্তু.... না থাক. আমি কে বলার! সময় অনেক কিছু বলবে. সেটা জয়দার কবিসত্তা নিয়ে না, সম্পাদক সত্তা নিয়ে!
আমি ভুল হতে পারি.
কিন্তু জয়দা খুব ভালো মানুষ. অনেকের কাছ থেকে যন্ত্রণা পেয়েছেন. সেই যন্ত্রণা উনি নিজেই ডেকে এনেছেন. সে গল্প পরে হবে! আমার শুধু একটি ঘটনা মনে পড়ে. তখন সূর্য পড়া ছাই বেরিয়ে গেছে. আর পাগলি তোমার সঙ্গে এর জন্য উনি সাহিত্য আকাদেমি পেয়েছেন. আমার সঙ্গে ফোন এ কথা প্রসঙ্গে আমি অভিনন্দন জানানোর বদলে বললাম এত ভালো ভালো বই থাকতে পাগলি তোমার সঙ্গে??? এটা তো আপনার অন্যতম দুর্বল কাব্যগ্রন্থ. শুনেই উনি রেগে গেলেন. রেগে যাবারই কথা. একজন কবিকে ধারাবাহিক ভাবে পড়ে যেতে হয়. কে জানে আমি-ই হয়ত ভুল বলেছিলাম! তবে আমার কাছে উনি আলেয়াহ্রদের কবি, ভুতুম ভগবানের কবি, উন্মাদের পাঠক্রম এর কবি. কী অসাধারণ সব কবিতা! কী কল্পনা শক্তি! কবিতাগুলি যেন অবচেতনা-দুখ্য-যন্ত্রনা সবকিছুকে দুই হাতে ধরে রাখে!
সেইদিন দুজন কবি তাঁদের বই আমাকে পড়তে দিলেন. দেবাযুধ আর অনুপম. অনুপম অনেক দিন লিখছেন. তাঁর কবিতার আমি অনুরাগী পাঠক. দেবাযুধ এর কবিতা পড়ে আমি মুগ্ধ. আর একজনের কবিতা পড়ে আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম.তিনি শ্রীদর্শিনি. 
মাসুদ খান বা ব্রাত্য রাইসুর কবিতা আমাকে পড়িয়েছিলেন মৃদুলদা. এই দুজন বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি বলে আমার মনে হয়. রণজিত্দার বাড়িতে একদিন আলাপ হয়েছিল সাজ্জাদ শরিফ এর সঙ্গে. তাঁর কবিতার আমি ভক্ত পাঠক. তবে তিনি বেশি লেখেন না. অবশ্য বেশি লিখলে কি বা হয়! জেমস জয়েস তো জীবনে পনেরটি ছোট গল্প, তিনটি উপন্যাস আর একটি ছোট কবিতার বই লিখলেন! তাতে তাঁর লেখা কি সময়ের কাছে নেই?
আমি যাঁর গদ্য পাগলের মত পড়েছি. তিনি আখতারুজ্জামান ইলিয়াস. 
এই রকম একজন গদ্যকার বাংলা ভাষাতে এসেছে ভাবতেই রোমাঞ্চ লাগে!
সত্যি কথা বলতে কী, এই বাংলার সাম্প্রতিক গদ্যসাহিত্য পড়া যায়না জাস্ট. কোথায় ছিলেন তিন বন্দোপাধ্যায়, কোথায় সমরেশ বসু,সুবোধ ঘোষ, শরদিন্দু, কমলকুমার, অমিয়ভূষণ, সন্দীপন চাটুজ্যে, অরূপ রতন বসু, আর কোথায় এখন কার লেখা! বিশ্বসাহিত্য যখন ন্যারেটিভ থেকে বেরিয়ে গেছে, তখন এখানে বৌদি আর কলেজ যাত্রীদের মুগ্ধবোধ কে মাথায় রেখে লেখা হচ্ছে সিরিয়াল সুলভ উপন্যাস. 
একমাত্র বিভাস দা ছাড়া কারোর উপন্যাস প্রায় যায় না!
হর্ষ দত্ত অনেক শক্তিশালী গদ্যকার. কিন্তু এখন তাঁর সম্পাদক সত্তা তাঁকে মেরে এনেছে প্রায়. 
শীর্ষেন্দু এখনো জীবিত লেখক.
সুনীল গাঙ্গুলি যথেষ্ট বড় মাপের লেখক.
কিন্তু এঁদের পর কাউকে দেখতে পাচ্ছেন?
বাংলাদেশে কিন্তু লেখা হচ্ছে.
ওহ বলতেই ভুলে গেলাম সেদিন অফিস থেকে বেরিয়ে হঠাত দেখা রাহুলদার সঙ্গে. 
অসম্ভব ভালো কবি.
আমার বীরেন্দ্র পুরস্কার পাবার দিনটার কথা মনে পড়ছে.
কী সব যে বলেছিলাম!
আমি আজি কাকে যেন বলছিলাম বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যের কথা ভাবলে শঙ্খ ঘোষ, বুদ্ধদেব বসু, সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়, শিবাজি বন্দোপাধ্যায়, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত ছাড়া আর কারোর কথা তো মনে পড়ছে না.
এই জায়গা থেকে ভাবলে আমাদের সাম্প্রতিক  কবিতা কিন্তু অনেক বেশি আন্তর্জাতিক. কিন্তু গদ্য সাহিত্য না. কেউ পড়েন না মনে হয়. 5০ দশকেও বাংলা সাহিত্য অনেক বেশি গ্লোবাল ছিল. কিন্তু এখন?
অবশ্য আমি বলার কে?
সময় বলুক.
হঠাত খুব মন খারাপ করছে. কেন এসব লিখলাম! এগুলো তো একদমই আমার ব্যাক্তিগত পছন্দ. আমার মনে হওয়াটাই ঠিক এমন তো না. ভিজে একটা হাওয়া দিছে. আর আমার মন শরীর সব একলা হয়ে যাচ্ছে. 
চোখের সামনে দিয়ে চকিতে ভেসে যাচ্ছে কয়েকটি দৃশ্য. গার্গী. বাবা. বাবার সেতার বাজানো. মন্দারমনিতে আমার আর গার্গীর বসে থাকা. কালো সমুদ্রের গর্জন. হাওয়া.
গলায় টিউমার ধরা পড়ার পর থেকেই কেমন মনে হয় বেশিদিন আর নেই হয়ত আমার জীবন. যদিও ডাক্তাররা বলেছেন বেঁচে যাচ্ছি. কিন্তু একটা ওষুধের গন্ধ আমাকে ঘিরে থাকে.
ফিনফিনে একটা চাঁদের আলোতে দুপাশে ঘন জঙ্গল. আর আমি সেখানে একটা চায়ের দোকানে বসে অপেক্ষা করছি. কার জন্য কে জানে! 
মনে আছে পাহাড়ের আদিম গন্ধ মেখে চির্বাসাতে চটিতে রাত কাটানোর কথা. মনে আছে ভোরবেলাতে এক সাধুর সঙ্গে দেখা হয়েছিল. তিনি আমাকে বলেছিলেন মন শুধু শরীরে থাকে না. মন থাকে শরীরের বাইরেও. আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম এই যে এখানে বসে থাকেন কি পান?
আমাকে উনি উত্তর দিয়েছিলেন - মন.
তার পর বলেছিলেন শুধু মানুষের মনের ভিতরেই মন নেই. আছে মানুষের বাইরেও. মানুষ সেখানে আছে. সেই বড় মনের ভিতরে লুকিয়ে আছে মানুষের অনাদি কালের কথা. সেদিন একজন কে কথা প্রসঙ্গে বলছিলাম যদি মানুষের পরম জ্ঞান এসে থাকে, তবে আমরা সেই কথাকে নানা ভাবে ব্যাখ্যা করে যাচ্ছি মাত্র. আমরা কি কোনো নতুন কথা বলছি?
হয়ত নতুন কথা বলার কিছু নেই. কথা গুলোকে খুঁজে পাওয়ার আছে. 
এর জন্য দরকার স্তব্ধতা.
কিন্তু কথা কথা কথা কথা কথায় আমাদের খোঁজ বা অনুসন্ধানটাই আর থাকছে না. 
জীবনানন্দ কথিত নিরভিসন্ধি কে এই খোঁজ?
লেখা যদি ধ্যান হয়, তাহলে কি লেখা চিন্তাশূন্য হতে পারে?
ধ্যান কি চিন্তাশূন্য আদৌ হয়?
এই শহরের মধ্যে কি আছে আরো অন্য কোনো শহর?
সেই তিনটি গ্রাম?
সেই নদীর দেশ?
সেই মন্থরতা?
মাদুর পেতে দুপুর?
(ক্রমশ)

Comments

  1. লিখাটা কেমন যেন করে দিল আমাকে। যখন অফসে থাকি তখন নানা রকম কাজের ভিতরে থাকি। বিরক্ত লাগে অনেক সময়। আপনার লিখা আমার ক্লান্তি বোধ কে প্রশমিত করে। আমি নিঃশ্বাস নিতে পারি। আমাকে যেন বহু দূরে নিয়ে যায় "এলোমেলো কথা"। জয় দা বলতে কি জয় গোস্বামীর কথা বুঝিয়েছেন??

    ReplyDelete
  2. apnar elomelo katha amai hathat hawar parash diye jai. evabe i to haito ekjoner valolaga mandolaga bahujon ke parsho kore jai.

    ReplyDelete

Post a Comment