এলোমেলো আমি-৪



এলোমেলো আমি-৪

মাঝেমাঝে পুরনো দিনগুলোর কথা খুব মনে পড়ে. নব্বই দশকের শুরুর সেই দিনগুলি. অয়ন, সৌরভ,  অনির্বান, মণি, জয়দীপ, সার্থক, রাজর্ষি,  শুভাশীষ, সুদীপ্ত, মুকুট....কী দারুন সব আড্ডা হত. সেই সময়ে বেরোত গান্ধার পত্রিকা আর বিজল্প পত্রিকা. এই দুটো পত্রিকায় বলতে গেলে নব্বই দশক কে ধরে রেখেছিল. ভোলা যাবে না গান্ধারের শেষ পাতায় অয়ন-এর লেখাগুলো. বইমেলাতে সকলের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে গান্ধার নিয়ে আমরা বসতাম মাটিতে. অয়ন-এর ছিল অসাধারণ রসবোধ. তেমনি ছিল অনির্বান. এরা সকলেই আছে, কিন্তু গান্ধার পত্রিকাটি বহুদিন হলো বন্ধ. সেই সময়ের কথা মনে হলে ভালো লাগে. আর কিছু না হোক, বুকের পাটা ছিল সকলের মধ্যে. আর ছিল বন্ধুত্ব. ঠিক কবিবন্ধুতা নয় এটা. বলা ভালো বন্ধুতা. এখনো অনির্বাণ-এর সঙ্গে আড্ডা হলে বা অয়ন-এর সঙ্গে হঠাত  দেখা হলে সেই বন্ধুতা টের পাই আমি. শুভাশীষ এখনো কফি হাউস এ যায়. জানি আবার গেলে দারুন আড্ডা হবে. কিন্তু সেই সময়টা কি ফিরে আসবে? মণি এখন নিউজিল্যান্ড-এ. হয়ত ওর বইটা বেরোবে এ বছর বেরোবেই পুজোর আগেই. কিন্তু সেই সব দুর্দান্ত আড্ডাগুলো ফিরে আসবে কি না জানি না. ভালো হোক, খারাপ হোক, নিখাদ এক বন্ধুতা ছিল আমাদের মধ্যে. সেই বন্ধুতা এখনো আছে জানি. তথাকথিত কবিতা জগতের মত নয় সেই বন্ধুতা. কবিতা জগতের লোকেদের সঙ্গে দেখা হলে, বা একসঙ্গে কোথাও কবিতা পাঠ ইত্যাদি হলে আমার খুব অস্বস্তি হয়. কী কৃত্রিম সব ব্যাপার স্যাপার! সবাই যেন কিছু না কিছু প্রমান করার জন্য মুখিয়ে আছে. এ যেন একটা বাজার , যেখানে পারফরমেন্স-ই আসল. আমি কীরকম কার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতে পারলাম, কী কথা বললাম, আগামী কোনো প্রজেক্ট এর জন্য একটু নিজেকে বুক করিয়ে রাখলাম....এটাই আসল. নিখাদ হাসাহাসি, ঠাট্টা, মজা এই সব বিষয়গুলো উবে গেছে. চরম এক পেশাদারী মনোভাব. হাসিও মেপে মেপে. প্রশংসাও মেপে মেপে. কথাগুলো সব ফাঁপা. কেউ কারো সঙ্গে আসলে কথায় বলছে না., সম্পর্ক  রাখছে শুধু.
এই প্লান প্রোগ্রাম করে কি লেখক কবি হওয়া যায়? গান্ধার পত্রিকা যারা করত তাদের মধ্যে ব্যক্তিত্ব ছিল. অয়ন শুনলেই খাঁক খাঁক করে হেসে উঠবে জানি. কিন্তু এ কথা ঠিক, একটা সাহস ছিল. অস্বীকার করার এবং অনুসরণ না করার. কিছু এসে যেত না কোনো বড় কাগজে লেখা ছাপা না হলে. এমন কী, বড় কাগজে লেখা ছাপানোর জন্য কোনো বড় লেখক কে তৈল প্রদান করার কোনো কারণ ছিল না. কারণ গান্ধার পত্রিকা এবং আমাদের বন্ধুবান্ধব জানে, তাদের ক্ষমতা. ফলে নব্বই দশকের প্রথমের সেই অসম্ভব ক্ষমতা সম্পন্ন কবিরা পরবর্তীকালে বড় কাগজের বিখ্যাত কবি-সম্পাদকের কাছ থেকে সেই স্বীকৃতি পেলেন না যে স্বীকৃতি তাদের পাওয়া উচিত ছিল. কারণ তাঁরা অনুসরণ করেন নি কাউকে. অন্ধ ভক্ত হননি কারোর. তাঁদের ব্যাক্তিত্ব ছিল, আছেও. 
প্রসূন-এর কথাও মনে পড়ে. ভৌমিক. বুয়া ও বাবুই কাব্যগ্রন্থ যার হাত দিয়ে, জীবন দিয়ে বেরোয়. অসম্ভব ভালো বন্ধু. মানুষ হিসেবেও খুব ভালো. চিরদিন সকলের উপকার করে গেছে. নিজের ব্যাক্তি জীবন যখন সংকটাপন্ন, তখনও, মাঠে নেমে পড়েছে আন্দোলনের জন্য. পরে তার সঙ্গে আমার রাজনৈতিক মতবিরোধ হলেও এ কথা তো ঠিক,যে প্রসূন নিজের জন্য কিছু গোছানোর কথা কখনো ভাবেনি. 
নব্বই দশকের এই যে প্রথমার্ধ, তা আমার কাছে বাংলা কবিতার এক স্বর্ণযুগ. নিজের মত করে নিজের ভাষা তৈরির সাহস ছিল তাদের মধ্যে. এখন হয়ত আমরা একে অপরের থেকে অনেক দূরে অবস্থান করি. পেশাগত কারণে. কিন্তু এ কথাও ঠিক, যে সেই চরিত্র এখনো সকলের মধ্যে রয়েছে. কারণ এরা যদি নিজেদের গোছাতে চাইতো, তাহলে অনেকেই উঠতে পারত না. 
কিন্তু একজন কবির মূল বৈশিষ্ট তার আত্মসম্মান. কোনো কিছুরই সামনে মাথা নত না করা. 
সেই আড্ডাগুলো ছিল সর্বগ্রাসী. ছিল অনেক মধুর. অনেক নির্মল. অনেক কবিতার মত. কবিতা লেখাটাই ছিল মূল উদ্দেশ্য. কবি হওয়া নয়. আর ঠিক উল্টো ব্যাপারটাই পরবর্তীকালে দেখা যায়. কবিতা লেখার চেয়ে প্রধান হয়ে ওঠে যখন কবি হিসেবে পরিচিত খ্যাতিমান হবার আকাঙ্খা. 
আমার ব্যাক্তিগত ভাবে মনে হয়, কবিতা লেখার চেয়ে কবি হব কীভাবে সেটা যদি ভাবনার মধ্যে একবার হানা দায়, তাহলে সেই কবি শেষ. 
কত ভালো ভালো কাগজ বেরোত সেই সময়ে. অর্হন, বিজল্প, গান্ধার. লুত্ফর রহমান বলে আমাদেরই একজন বন্ধু অসামান্য গদ্য লিখত. কিন্তু সে যে কোথায় গেল জানিও না. 
সার্থক যেমন! সেই ২০০০ সালে ওর একটি কবিতার বই বেরিয়েছে. অন্ধকারের অনুবাদ. অসামান্য কাব্যগ্রন্থ. কিন্তু তার পর ১২ বছর কেটে গেল, আর কোনো কবিতার বই নেই. অথচ জানি ও লিখছে. সৌরভ পান্ডে. এখনো লিখছে. ওর একটা অদ্ভুত পাগলামি আছে. ও মনে করে ও সব লেখা নিয়ে একটাই কবিতার বই প্রকাশ করবে, আর সেটা হবে ওর কাব্যসমগ্র. 
কিছুদিন আগে সৌরভ এর সঙ্গে ফোনে কথা হলো. কিন্তু তার পর আমার শারীরিক অসুস্থতা এবং ফোন হারিয়ে ফেলার দরুন ওর সঙ্গে আবার যোগাযোগের উপায় নেই বললেই চলে. কবে যে আমাকে আবার ও ফোনে করবে কে জানে! 
এই সব বন্ধুদের সান্নিধ্য আমি মিস করি. আমার নিজের মধ্যেই অনেক গন্ডগোল আছে আমি জানি. কবি বিভাস রায়চৌধুরী আমাকে একবার বলেছিল, আমি কবি হিসেবে ভালো কিন্তু বন্ধু হিসেবে ভালো নই.
কথাটি আমাকে ভাবায়. সমস্যাটির সূত্রপাত কোথায় আমি জানি না. আমি নিজে অন্তত কোনো বন্ধুকে আহত করি নি. আর যদি করেও থাকি, তার জন্য ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি. 
নিজের সম্পর্কে আমি ভাববনা ভেবেও ভেবে ফেলি মাঝেমাঝে. সত্যি তো আমি কবিতার জন্য কোনো ধান্দাবাজি করিনি. শ্রদ্ধা করলেও আমি কোনো বড় কবির বাড়িতে নিয়ত যাইনি. আমার সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক লেখার মাধ্যমেই. যাঁদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক  হয়েছে, তা আপনা থেকেই হয়েছে. সেখানেও আমি খুব অনিয়মিত. যেমন কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত আমাকে খুব স্নেহ করেন. শঙ্খবাবু আমাকে স্নেহ করেন. তবু তাঁদের সঙ্গে নিয়ত যোগাযোগ রাখা আমার পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না. কবীর সুমন আমাকে অসম্ভব ভালবাসেন. কিন্তু তিনি নিজেকে নিয়ে থাকেন. বিশেষ করে এই সময়ে আমি তাঁর সহযোদ্ধা হয়ে তাঁর পাশে আছি.
এই কবীর সুমন যে আমার জীবনে কী ভূমিকা নিয়ে আছেন, সে সম্পর্কে লিখতে গেলে এই পর্যায়টি কখনো শেষই হবে না. মানসিক ভাবে যখন ভেঙ্গে পড়ে আছি, সে সময়ে সুমনদার তোমাকে চাই এসেছিল আমার কাছে. তার পর একে একে অসামান্য সব গান. শুধু গান নয়, কবীর সুমন একটা মনোভাবের নাম. যিনি নির্ভয়ে প্রশ্ন করার, একাকী সৃজনের মধ্যে থেকে সৃষ্টি করে যাওয়ার এক দৃষ্টান্ত. অনেক কথা হয়েছে তাঁর সঙ্গে. অনেক কথা হয়. কিন্তু তাঁর জীবন থেকে একটি জিনিস আমি নি:শব্দে   গ্রহন করেছি. আর তা হলো কোনো ছাঁচের মধ্যে নিজেকে না বেঁধে ফেলা. সুমনদাকে নিয়ে আরেকদিন লিখব.
আমার মন চলে যাচ্ছে নানা স্মৃতির মধ্যে. ভাস্করদার সঙ্গে একদিন দেখা হয়েছিল সিঁথির মোড়ে. আমার যাবার কথা ছিল. অসম্ভব সুন্দর একটি শার্ট পরে ভাস্করদা হাঁটতে বেড়িয়েছিলেন. আমার সঙ্গে দেখা হতেই বললেন চাল ফুচকা খাব. তার পর আমরা ফুচকা খেয়ে হাঁটা দিলাম দমদম স্টেশন-এর দিকে. যেতে যেতে কত কথা. মনে পড়ছে অভীককে, সুমন্ত কে. কৌশিক কে. অভীক দের বাড়িটা আশ্চর্য ভালো. চারিদিকে শান্ত পরিবেশ. সত্যি বাড়ির কাছে একটি করাতকল আছে. কতদিন বরানগরের ওই বাড়িতে আড্ডা দিয়েছি. কবিতা নিয়ে কাটিয়ে দিয়েছি সারা দুপুর.
সুমন্ত কি নীল অপেরা বন্ধই করে দিল? 
এই সুত্রে মনে পড়ে গেল রানাদা কে. 
রানা রায়চৌধুরী.
অসম্ভব ভালো কবি. কিন্তু তিনিও প্রাপ্য সম্মান পেলেন না.
কিন্তু করা দেবে প্রাপ্য সম্মান? কবিতা কি কোনো প্রতিষ্ঠানের দয়ার সম্মানিত হবার অপেক্ষায় থাকে? কোনো বড় কাগজের সুচিপত্র কি বাংলা কবিতার ইতিহাস ঠিক করে দেয়? 
না কি সাম্প্রতিক কাগজগুলি ঠিক করে করা কবি এবং করা কবি নয়?
প্রতিষ্ঠান হোক, বা প্রতিষ্ঠান বিরোধী, কোনো কাগজ, কোনো কবি, কোনো শক্তি, কোনো কমিটি ইতিহাস তৈরী করতে পারে না. 
সাহিত্য ভীষণ নির্মম. সময় সত্যি নিরপেক্ষ. যার লেখা থাকার তার লেখা থাকবেই. আর যার থাকার না তার থাকবে না. 
নব্বই দশকের শুরুতে এই বিশ্বাসের জায়গা থেকেই তো ছিল আমাদের সেই সাহস. প্রয়োজনের থেকে আয়োজনের আধিক্যে আমরা বিশ্বাসী ছিলাম না কখনো. জীবনানন্দের কবিতার কথায় আছে কবির আত্মবিশ্বস্ত থাকার কথা. Poetics-এ আছে কবি সমস্ত ক্ষমতার বাইরে থাকা এক ব্যাক্তি. 
শিল্পীর স্পর্ধা যদি না থাকে তবে সেই শিল্পী তো আত্মবিক্রয় করে আছে!
আমরা কি পড়িনি রিলকের কবিতা নিয়ে বুদ্ধদেব বসুর অসামান্য ভূমিকাটি?

Comments