এলোমেলো আমি-২০


এলোমেলো আমি-২০

সকাল থেকে মন যে কেন অজয় নদী অজয় নদী করছে কে জানে! এই সময় শান্তিনিকেতন ঠিক কেমন? সেখনে হয়ত হেমন্ত এসে গেছে. পুজোর মন্ত্রের সঙ্গে বেরিয়ে পরার এক অদ্ভুত টান আমি অনুভব করি. সেই বেড়িয়ে পড়া কিন্তু এই কলকাতার মধ্যে নয়. বেড়িয়ে পর হাওয়ায় , হাওয়া বাইরে থেকে ডাকছে. শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের এই কবিতাটা মনে পড়ল. মনে পড়ল চাকার বাতাসে ঝরা পাতা উড়ে যায়. চারিদিকে বেশ উত্সব উত্সব ভাব. মানুষ শত কষ্টের মধ্যে থাকলেও হয়ত এই সময়গুলিতে সব ভুলে যায়. আমি যে ভুলতে পারি না. মনে আছে একজনের বাড়ি. তাদের বাড়ি থেকে একটা সরু গলি দেখা যেত. আমি সকাল বেলা জানলা দিয়ে তাকিয়ে থাকতাম বাইরের দিকে. এই সপ্তমীর দিন দেখেছিলাম কলাবৌ নিয়ে স্নানে যাওয়ার দৃশ্য. আমার খুব ইচ্ছে ছিল পরের বছর কেমন ভাবে কলাবৌ স্নান হয় তা দেখার. কিন্তু পরের বছর আর পেলাম কি? 
এই যে বিভিন্ন অনুষ্ঠান, এই সব অনুষ্ঠান আমাদের জাতীয় মননে কতদিন ধরে যে রয়েছে. কোনো একটা বিশেষ কারণ থেকে এই সব আনুষ্ঠানিক বিষয় তৈরী হয়. তার পর সেগুলির পিছনে কোনো না কোনো দৈব কারণ জুড়ে দেয় আমাদের পুরোহিত তন্ত্র. তার পর সেই পুরোহিত তন্ত্র্রকেই অনুসরণ করতে থাকে আমাদের সংস্কৃতি দিনের পর দিন. বিষয়টি মজার. আমার কাছে এ জন্য সব ধর্মই ইতিহাস. সব ধর্মের আচার অনুষ্ঠানের মধ্যে ইতিহাস নানা ভাবে লুকিয়ে রয়েছে. আমরা অভ্যেসের বসে কেবল আনুষ্ঠানিক চর্চা করে যাচ্ছি. কিন্তু সেই প্রতীকের মর্মে প্রবেশ করতে পারছিনা. 
কিন্তু আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা যদি এমন হতো যে ধর্মের নানা বিষয়ের মধ্যে লুকিয়ে থাকা প্রতীকের ইতিহাস ধরে ধরে অতীতে যাওয়ার পাঠক্রম রাখত., তাহলে বেশ হত. তাহলে অন্তত সব ধর্মের মানুষ বুঝতে পারতেন যে ধর্মগ্রন্থগুলি ইতিহাসের শিলালিপি ছাড়া আর কিছুই নয়. আমি এই ইতিহাসের শিলালিপি কথাটি যে ব্যবহার করলাম, এই শিলালিপি কিন্তু আমাদের মনের মধ্যেই আছে দীর্ঘকাল ধরে. 
এই যে খবর কাগজ গুলো বন্ধ হলো, কী যে ভালো হলো! 
আমি মাঝেমাঝে কিছু অদ্ভুত বিষয় ভাবি., যেমন সব কাগজ যদি বন্ধ হয়ে যায়! ধরা যাক মানুষের জীবনে কোনো কাগজ নেই. কোনো সংবাদপত্র নেই. তাহলে কি হবে? মানুষের জীবন থেকে সব খবর যদি মুছে যায় তাহলে কী হবে? মানুষের সব সকাল গুলোতে এক ভয়ংকর সংকট তৈরী হবে. আমি ব্যাক্তিগত ভাবে এমন একটা পৃথিবীতে পৌছে  যেতে চাই, যেখানে কোনো খবর কাগজ নেই. আমি কি খুব বেশি মাত্রায় মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছি? হাহাহাহা!
গত পরশু ট্যাক্সিতে  আসতে আসতে একটা দৃশ্য দেখলাম. মনটা অন্যরকম হয়ে গেল. ওই বিডন স্ট্রিটের ওখানে দেখেছিলাম ঠাকুর আসছে. আর তার পিছন পিছন একটা শববহনকারী  গাড়ি যাচ্ছে! ঠিক পিছনে পিছনে. কী আশ্চর্য! সামনে উল্লাস এবং পিছনেও উল্লাস. প্রচন্ড আনন্দ হয়েছে এমন ভাবে তারা হরি বল হরি বল করছে. এই শব নিয়ে যাওয়া চিত্কার আমি একদম সহ্য করতে পারি না. শব নিয়ে যাওয়া উচিত নীরবতায়. কিন্তু মানুষ কেন যে আএত চিত্কার করে! শোক ঢাকার জন্য. তারা খই ছড়িয়ে দিছে আর ঠাকুর নিয়ে আসা লোকজন ছড়িয়ে দিচ্ছে ফুল. হয়্তবিসর্জনেও এইরকম কোনো দৃশ্য দেখব. 
সবাইকেই চলে যেতে হয়. সবাই যায়. চলে যায়. কেউ কেউ ফেরে কেউ ফিরতে পারে না. এটি যেন কোন একটা কবিতায় লিখেছিলাম! আমার ছোটবেলা তো কেটেছে রামতনু বোস লেনে. আমার মা তখন এম এ পড়ছে. আমি বড় হয়েছি আমার মামার বাড়িতে. আমার দিদিমা এবং মাসির কাছে. আমার মনে আছে উত্তর কলকাতার গলিগুলোর গন্ধ. ওখানে তো সদর দরজা খোলায় থাকে. আমার মনে আছে আমি বেড়িয়ে পড়তাম. এ গলি সে গলি. কোথাও রাস্তা থেকে বেরোনো গঙ্গা জল এ স্নান করছে মানুষ, কোথাও প্রচন্ড ঝগড়া. কোথাও টিং টিং করে রিক্সা ঢুকছে. আর আমি ভালবাসি ট্রাম. ওই যে মন্থরতার কথা বলছিলাম, উত্তর কলকাতার মধ্যে এই মন্থরতার বিষয়টি রয়েছে. সুন্দর খুব. আমার দক্ষিন কলকাতা কেন জানি না ভালো লাগে না. এই গাদা গাছের শপিং মল তো নয়ই. আমার ভালো লাগে হাতিবাগান বাজার. ভালো লাগে হকার. ভালো লাগে তাদের ডাক. তাদের সঙ্গে দরাদরি. আর টুক করে কোনো রেস্তোরায় ঢুকে চপ কাটলেট. রাস্তার দোকানে ভাঁড়ে চা. হেদুয়ার দিকে যেতে গিয়ে নকুরের গলিটার উল্টোদিকের গলির মুখে একটা অসাধারণ চায়ের দোকান আছে. হিন্দু স্কুল থেকে প্রায়শই আমি হেঁটে ফিরতাম আর ওই দোকানে চা খেতাম. আবার আমাদের বন্ধুরা মিলে এখন বন্ধ রংমহলের উল্টোদিকে অসামান্য একটা চপের দোকান আছে. সেখানেও খেতাম. ওদিকে একটা খুব ভালো বইয়ের দোকান আছে. অনেক পুরনো বই আমি কিনেছি ওই বইয়ের দোকান থেকে. মনে আছে সত্যেন বোস এর বাড়ির সামনে যে সরু গলি, যেটা মনে হয় কলকাতার সবচেয়ে সরু এবং দীর্ঘতম গলি সেটাতে ঢুকে কী আনন্দ হয়েছিল! আরেকটা সুন্দর সরু গলি আছে ফরেপুকুরে. 
উত্তর কলকাতার মধ্যে প্রাণ আছে. যেটা এই আমাদের কালিন্দী-লেকটাউন- সল্ট লেক, দক্ষিন কলকাতায় নেই. 
বা, হয়ত এটি আমার মনের ভ্রম হতে পারে. 
উত্তর কলকাতা নিয়ে আমি অনেক কবিতা লিখেছি.আমার তুমি,অরক্ষিত কাব্যগ্রন্থে পাতায় পাতায় রয়েছে উত্তর কলকাতা. তবে একজন কবির উত্তর কলকাতার কবিতা পড়ে আমি মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম. তিনি কবি প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়. এই একজন বড় মাপেরকবি ও চিন্তক. এ সব সম্ভবত আমাদের বাংলা ভাষাতেই সম্ভব যে যাঁরা নীরব ভাবে লিখে যান শুধু, তাঁদের কবিতার কথা বেশির ভাগ পাঠক জানতে পারেন না. বেশির ভাগ পাঠক হচ্ছেন প্রচার মুগ্ধ. প্রচার মাধ্যম যাদের কথা ফলাও করে বলে, তাদের একটি সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা আছে. তাঁরা পড়েও দেখেন না অন্যেরা কী লিখেছেন! পাঠক বিচার করতে পারেন না করা সত্যিকারের কবি. পাঠক পার্সোনালিটি-র কাছে যান না. পাঠক যান বিজ্ঞাপিত বস্তুর কাছে. প্রচার মাধ্যমের কাজী হলো প্রোডাক্ট বেচা. এটি দোষের না, কিন্তু প্রচার মাধ্যম তাঁদের যাবতীয় জ্ঞান সহ বুঝতে পারেন না এবং তাদের সেই সার্ভেও নেই, যে কাদের কবিতা সময়ের কাছে থাকার মত এবং কাদের কবিতা নয়. গৌতম বসু, পার্থ প্রতিম কাঞ্জিলাল, রমেন্দ্র কুমার আচার্য চৌধুরী, গৌতম চৌধুরী , দেবদাস আচার্য -- এঁদের কবিতা কজন পড়েন? অথচ নিশ্চিত ভাবেই তাঁদের কবিতায় আছে আগামীর কবিতার কথা, বীজ. হয়ত তাঁদের কবিতা সময় রাখবে. কারণ সময় বোকা নয়. সময়ের কোনো স্বার্থ নেই. 
সে যাই হোক, কোথা থেকে কোথায় এসে পড়েছি. আমাকে ডাকছে সব ছোট ছোট নদীগুলো. ছোট ছোট নদীর মন্থর বয়ে যাবার ভিতরে কী শান্তি আছে তাই না? আমি কালকে লিখেছিলাম একটি ভীষণ চমক বাজির পৃথিবী তৈরী হয়েছে. তা শুধু যে আমাদের চারপাশের জীবন যাত্রায় তাই নয়, তৈরী হয়েছে 
আমাদের মনে. আমরা খুব তাড়াতাড়ি ভোগ করার রাস্তায় পৌছতে চাই. সে ভোগ নানা রকমের. কক্ষনো সেই ভোগ পড়ার,  কখনো সেই ভোগ নিজেকে বেচার, নিজেকে বিজ্ঞাপিত করার, কখনো সেই ভোগ ভালবাসার. নিজের লেখা, নিজের ভালবাসা, নিজের পড়া --এগুলিকে জারিয়ে নেওয়ার জন্য যে কিছু কিছু অনুভূতির সঙ্গে আমার মন্থর সহবাস প্রয়োজন তা মানুষ ভুলে গেছে. তাই এখন পড়া থেকে অভিজ্ঞতা, ভালো লাগা, ভালবাসা সবই ক্ষনস্থায়ী. আর ক্ষনস্থায়িত্ব কখনই কোনো বড় মাপের কিছুর কাছে আমাদের নিয়ে যায় না.
প্রয়োজনের চেয়ে আয়োজন বেশি যে জীবনযাত্রায়, তা তো যন্ত্রনাময় হতে বাধ্য. আর সেই যন্ত্রনা ভোলার জন্য আমরা আবার কোনো ক্ষনস্থায়ী বিষয়ের মধ্যে নিজেকে নিযোগ করে রাখি. তখন আমাদের সময় কোথায় কোনো মন্থরতার সঙ্গে সহবাস করার? 
একজন কবি বা একজন শিল্পী যদি এই ক্ষনস্থায়ী বিষয়কে পরিবেশনের দিকে জোর দেন, তাহলে তা মারাত্মক বিপদের কারণ. কিন্তু এখন সেটাই হচ্ছে. প্রকাশ কারো অথবা নিজেকে মুছে ফেল. এই হচ্ছে এই সময়ের বৈশিষ্ট. কিন্তু এতে মানুষ ক্লান্ত হয়ে যাবেই যাবে. যারা সৃষ্টি করছেন তারাও হবেন, এবং যারা ভোগ করছেন তারাও হবেন. 
নদীর কথা বলছিলাম. আমি স্বপ্নে দেখি এমন কোনো নদীর ধরে আমার ছোট কুটির, আমার কোনো চাপ নেই, কোনো দৌড়ে যাওয়া নেই. আমার কোনো টেনশন নেই. আমার কোনো প্রমান করার নেই. আমি খুব আনন্দে আছি. এমন স্বপ্ন দেখি. স্বপ্ন দেখি আমি সেখানে একটু একটু করে লিখছি আমার ভাবনাগুলিকে. আমার কবিতাকে. আর কবিতাও আমাকে একটু একটু করে লিখছে. কারোর কোনো তাড়া নেই. 
হারমান হেসের সিদ্ধার্থ উপন্যাসটা আবার পড়তে ইচ্ছে করছে. 
আজ সপ্তমী. আজ বাড়িতে আছি. হয়ত আবার লিখব. 
(ক্রমশ)

Comments

  1. "আমার ভালো লাগে হাতিবাগান বাজার. ভালো লাগে হকার. ভালো লাগে তাদের ডাক. তাদের সঙ্গে দরাদরি. আর টুক করে কোনো রেস্তোরায় ঢুকে চপ কাটলেট. রাস্তার দোকানে ভাঁড়ে চা. হেদুয়ার দিকে যেতে গিয়ে নকুরের গলিটার উল্টোদিকের গলির মুখে একটা অসাধারণ চায়ের দোকান আছে." মাঝে মাঝে বোধ হয় প্রিয় মানুষদের সাথে মনের মিল্গ গুলো এক হয়ে যায়। আর সেই প্রিয় মানুষটা যদি প্রিয় লেখক ও হয় তাহলে ত কথাই নেই। মন ছুয়ে গেল লিখাটা।

    ReplyDelete

Post a Comment