এলোমেলো আমি-১৪


এলোমেলো আমি-১৪ 

আবার বৃষ্টি পড়ছে বাইরে. বেশ ভালো রকম বৃষ্টি. আবার জল জমবে. শরতে বর্ষা. কত চেষ্টা করছি বেশিরভাগ সময় চুপ করে থাকতে, কিন্তু কিছুতেই পারছি না. অনেক কাজের চাপের পর যখন সামান্য সময়ে মাথাকে চিন্তাশূন্য করে ফেলতে ইচ্ছে হয়, ঠিক তখনি আসে প্রবল বিষাদ. অলোকরঞ্জন আমাকে মজা করে বিষাদ কবি বলে ডেকেছিলেন. হাহাহা! বিষাদের নানা ভাষা. আর কোনো ভাষায় কিন্তু ফেলে দেবার মত না. আমার মা আমাকে বলেন মন খারাপ লাগলে রবীন্দ্রনাথের গান শুনতে. কি জ্বালা! রবীন্দ্রনাথের গান শুনলে তো আমার বিষাদ বাড়ে বই কমে না. আর বিষাদের কমার কারনটাই বা কোথায়? জীবনানন্দ যেমন বলেছিলেন আশাবাদ কি দশকর্মা ভান্ডারে পাওয়া যায়? 
পাহাড়ের প্রসঙ্গে মনে পড়ছে যে একবার গঙ্গোত্রী থেকে গোমুখ যাবার পথে আমার সঙ্গী হয়েছিলেন একজন সাধু. সে এক অদ্ভুত চরিত্র! বয়স আসি পেরিয়ে গেছে. কিন্তু পাহাড়ের চড়াই ওঠেন একদম পাখির মত. অনেক দিন নাকি হিমালয়-এই কাটিয়ে দিয়েছেন. জাতে বাঙালি. ভাষাতেও. আমাদের প্লান ছিল গঙ্গোত্রী থেকে গোমুখ হয়ে তপোবন ক্রস করে গঙ্গোত্রী গ্লাসিয়ার ধরে কালিন্দী খাল ক্রস করে সাতপন্থ গ্লেসিয়ার এর রাস্তা ধরে বসুধারা পেরিয়ে নামব বদ্রিনাথ এ. তো মাঝখানে থাকার কথা ভুজবাসাতে. ভুজ্বাসায় আছে লাল বাবার আশ্রম. আমি তো টানা ১৪ কিলোমিটার হেঁটে পৌছলাম যখন তখন সন্ধে হয় হয়. আশ্রমের ভিতরে গিয়ে দেখি সেই সাধু. আমি জিজ্ঞেস করলাম কি থাকবেন ভিতরে? বললেন না আমি থাকব বাইরে. দেখি একটা ছোট তাঁবুও আছে সঙ্গে. আমার খুব লোভ হলো তাঁর সঙ্গে তাঁবুতে থাকার. বললাম আমি থাকতে পারি? আমাকে উনি বললেন নয় কেন? 
সারারাত উনি রবীন্দ্রনাথের গান গাইলেন. আমার এমন অভিজ্ঞতা আগে হয়নি. আমার সঙ্গীরা সবাই ছিল লাল্বাবার আশ্রমে. কিন্তু আমি সেই চন্দ্রালোকিত রাতে সেই সাধুর সঙ্গে তাঁবুতে থাকতে থাকতে যা পেয়েছিলাম তা কখনো হারাবার নয়.
ভাবতে পারছেন? চারিদিকে মাত্রই শিখর, ভগীরথ শিখর, ভ্রিগুপন্থ, নাম না জানা শৃঙ্গ. চাঁদের আলোয় সমস্ত পাহাড় থেকে যেন দুধ নেমে আসছে, আর রাতে প্রার্থনার মত করে সেই সাধু উচ্চ কন্ঠে গাইছেন রবীন্দ্রনাথের গান. পূজা পর্যায়ের গান, প্রেম পর্যায়ের গান. আমি জিজ্ঞেস করলাম- আপনি কোনো পূজা করলেন না তো? আমাকে বললেন - রবীন্দ্রনাথের গান-ই তো আমার মন্ত্র. 
রবীন্দ্রনাথ নিয়ে আলোচনা হলো অনেক. 
অদ্ভুত প্রেমিক সেই সাধু. 
অদ্ভুত জ্ঞানী. 
আমাকে বলেছিলেন তোমার যখন মন  খারাপ হবে তখন রবীন্দ্রনাথ একদম শুনো না. সেই সময়ে বরং রবীন্দ্রনাথের লেখা পড়া ভালো. 
কথাটি আমাকে এখনো ভাবায়.
আমি দেখেছি মনের যখন কোনো অবসাদ নেই, তখন রবীন্দ্রনাথের গান শুনলে নিজেকে অনেক গভীরে নিয়ে যাওয়া যায়. 
রবীন্দ্রনাথের গান শুনলে আবিষ্কার করা যায় এমন সব অনুভূতির নিজেকে, যেখানে দাঁড়িয়ে মন অবসাদ না, বিষাদে চলে যায়.
অবসাদ আর বিষাদের মধ্যে পার্থক্য তো থাকেই.
ভার্জিনিয়া উলফ এর আত্মহত্যা এক বিষাদের থেকে. কিন্তু সিলভিয়া প্লাথ এর আত্মহত্যা অবসাদ থেকে.
জীবনানন্দের বোধ কবিতায় যে আত্মবিনাশী অস্তিত্বের কথা আছে, যা বিপন্ন বিস্ময়ের বোধে আক্রান্ত হয়ে সব কিছু থেকে নিজেকে বিযুক্ত করে ফেলে, সেই বিযুক্ত করার পিছনে আছে বোধের বিষাদ. 
বোধের বিষাদ আমার কাছে খুব প্রিয়. কারণ কবিতা লেখায় হোক, বা নিজের ভাবনা চিন্তাগুলিকে নিয়ে নিজের মধ্যে লুকিয়ে থাকা, সেই বোধের বিষাদ নিজের মধ্যে এক বর্মের কাজ করে.
তখন সহজেই অন্য সকলের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে পালানো যায়. তারা ছুটি দিতে না চাইলেও.
কি অদ্ভুত সুন্দর এই পৃথিবী. চারিদিকে মন ছড়ানো আছে. গাছের পাতায় মন. পুরনো গলির গন্ধে মন. চেনা অচেনা রাস্তায় মন. সব থেকে বড় কথা আকাশের মন. চারিদিকে কত সঙ্গীত. এই সঙ্গীত কি শোনা যায় একলা না হলে?
এই যে আমি অফিসে বসে লিখে যাচ্ছি, এই সব লেখা হয়ত আবোলতাবোল, কিন্তু মাঝে মাঝে হানা দিছে নানা কথা. নানা ভাবনা. আমি আমার ঘোরের মধ্যে ডুব দিতে পারছি. কারোর প্রতি আর আমার কোনো রাগ হচ্ছে না. কোনো স্মৃতির জন্য আর আমার আক্ষেপ হচ্ছে না. 
জীবনে আক্ষেপ নিয়ে বেঁচে থাকা এবং মরে যাবার কোনো মানেই হয় না. 
কারণ যে যাই বলুক আমি নিশ্চিত নই আমি আবার এই পৃথিবীতে ফিরে এসব কিনা. জীবনটা বড় মূল্যবান. কারণ দেখাটা মূল্যবান. 
আমার মনে হয় লেখার মাধ্যমেও আসলে আমরা দেখি. কি দেখি? আমার অনুভূতি জগতের মধ্যে মিশে থাকা বোধ কে দেখি শব্দে. লেখায়. লেখা তো এক ধরনের ছবি কে দেখা. প্রতিটি অক্ষর তো আসলে ছবি. সেই ছবিগুলো পাশাপাশি মিশে রচনা করে এক বোধের সাম্রাজ্য.
এক বোধের গন্ধ.
সঙ্গমের পর শরীর থেকে যে সোঁদা গন্ধটি বেরয়. প্রথম বৃষ্টির পর যে সোঁদা গন্ধটি বরয়. 
প্রতিটি নতুন লেখার মধ্যে যদি এই সদ্য বৃষ্টিস্নাত গন্ধ পাওয়া যায়, তবে প্রাণ সেই বোধ কে আশ্রয় করে বেঁচে উঠতে পারে. 
কবরখানায়  গেলে একটা গন্ধ পাওয়া যায় তার মত. সেই গন্ধ হলো অপূর্ণ ইচ্ছের গন্ধ. 
শিশুর গায়ে যে গন্ধটা পাওয়া যায় তা হলো কৌতুহলের গন্ধ. অচেনাকে চেনার গন্ধ. 
আসলে শিশুর গায়ের গন্ধ হচ্ছে সবচেয়ে পবিত্র. কারণ মানুষ তখন সবচেয়ে পবিত্র কাজটাই করে.
যা দেখিনি, যে ভাষা আমার চারপাশে চলছে, যে রং গুলো আমার চোখের সামনে আসছে, আমি সব গুলিকে চিনছি. এ তো অত্যন্ত পবিত্র কাজ. এ কাজ কেই আমি পূজা বলতে পারি. ধর্ম বলতে পারি. কারণ এই ধর্মের মানে হচ্ছে প্রকৃতিকে চেনার সুবাস. 
কি হিন্দু, কি মুসলমান, কি ক্রিশ্চান, আসলে এসব ধর্ম তো ইতিহাস. এক একটা সময় কে নানা রূপকে বলে আছে.
কিন্তু ধর্ম যদি বলি চেনা-জানার অভিযাত্রাকে, তাহলে বলতেই হবে একটি শিশুর ধর্ম যদি মানুষ সারাজীবন তার চোখের মধ্যে, তার মনের মধ্যে নিয়ে রাখতে পারে, তাহলে সে বাঁচবে নিজের মত, মরবেও নিজের মত. মাঝখানে দেখবে চিরশিশুর মত. 
এই চিরশিশুর মত দেখা শুধু প্রকৃতিকে নয়. প্রতিটি সম্পর্ককেও. প্রতিটি অনুভূতিকেও. প্রতিটি মুহুর্তকেও. 
আমি যদি বলি আমার ধর্ম শিশু, তাহলে তা ব্যাকরণ গত ভাবে খুব ভুল হবে, কিন্তু তা একটা প্রকাশ হবে.
এই প্রকাশ বিষয়টি গুরুত্বের.
খুব বৃষ্টি পড়ছে বাইরে. 
বৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে আমার মন ভিজে যাচ্ছে. 
আমার খুব দেখা করতে ইচ্ছে করছে তোমার সঙ্গে. মনে আছে. মনে পড়ছে.
আমার জন্ম শ্রাবনে. মৃত্যুও কি কোনো শ্রাবনে হলেই ভালো না?
(ক্রমশ)

Comments