এলোমেলো আমি -৩
এলোমেলো আমি -৩
যখনি মন খারাপ হয় আমি রবীন্দ্রনাথের ছিন্নপত্র খুলে বসি. ছিন্নপত্রের মধ্যে যে এমন মন ভালো করে দেওয়া, মনটাকে অন্য কোনো জগতে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা আছে তা আবিষ্কার করি কিন্তু অদ্ভুত ভাবে. এ প্রসঙ্গে হঠাত এ মুহুর্তে মনে পড়ে গেল রিলকের কথা. আর ভেসে উঠলো বুড়োদার চায়ের দোকানের কথা. আমাদের কলেজ স্ট্রিট-এ বহু প্রাচীন সেই চায়ের দোকানটার কথা. যেখানে প্রথম দেখা হযেছিল অচ্যুত্দার সঙ্গে. আমার সঙ্গে যখন অচ্যুত্দার আলাপ হয় তখন আমি সব ছেড়ে ছুড়ে দিয়ে নকশালপন্থী রাজনীতি করি, কবিতা লিখি আর পড়াই. প্রচুর বইপত্র পড়া, সিনেমা দেখা, থিয়েটার দেখা আর কফি হাউস এ আড্ডা দেওয়া ছাড়া আমার আর তখন করার কিছুই ছিল না. প্রেম তো ছিলই না. কবিতা লেখার সূত্রে অচ্যুত্দার সঙ্গে আলাপ. ভীষণ ভাবে অহংকারী মনে হয়েছিল অচ্যুত্দাকে. প্রথমেই সব কিছুকে নস্যাত করে দেওয়ার প্রবৃত্তি. তর্করত্ন বলা যায়. অচ্যুতদার সে ক্ষমতাও ছিল. অসামান্য কবিতা লেখার পাশাপাশি অচ্যুত্দার অন্যতম একটা গুন ছিল কবিতা বা সাহিত্যের কোন কোন বিষয়গুলিকে ধরে আমরা কথা বলতে পারি, সে সম্বন্ধে স্পষ্ট ভাবে বুঝিয়ে দেওয়ার. অচ্যুত্দার পরামর্শে বা বলা ভালো গালাগালিতেই আমি প্রথম জেমস জয়েস পড়ি. বালজাক পড়ি, দস্তয়ভস্কি পড়ি. অচ্যুত্দাই আমাকে প্রথম পড়ায় কমলকুমার মজুমদার আর অমিয়ভূষণ মজুমদার. ব্যাস. আমার হয়ে যায়. শৈশবে আমার বাবা তো আমাকে বিদেশী সাহিত্যের বইপত্র এনে দিতেনই. অচ্যুত্দার সংস্পর্শে এসে আমি বুঝতে পারলাম আমার আরো বেশি পড়া দরকার.
অচ্যুতদা হয়ত প্রথমে সবাইকে নস্যাত করে দিত বলে অনেকের বিরাগভাজন হয়েছিল, কিন্তু এ কথাও ঠিক, যে এখনো পর্যন্ত আমি অন্তত অচ্যুত্দার কোনো বিকল্প খুঁজে পাইনি. মনে আছে একদিন জলের বোতলে ভদকা ঢেলে আমি সার্থক আর অচ্যুতদা হেঁটে ছিলাম অনেক রাস্তা. অচ্যুত্দাই আমাকে বলেছিল, পার্টির ডেমোক্রাটিক সেন্ত্রালিসিম নিয়ে প্রশ্ন করলে ক্ষমতা তোকেও শত্রু ভাববে. সে যে ক্ষমতায় হোক না কেন. পরবর্তীকালে দেখেছি কথাটি কত সত্য. আমাদের পার্টির রাজ্য সম্মেলনে কলকাতার প্রতিনিধিত্ব করার সময়ে বর্ধমান'এ আমি কিছু প্রশ্ন করি. জানাই, যে, এই কলকাতার লোক হয়ে এলিট কলেজ এ রাজনীতি করে আমাদের পক্ষে বোঝা সম্ভব না গ্রাম বাংলার চরিত্র. এ হেন কথা বলার পর সেই বিশেষ সংগঠন থেকে আমাকে অপসারণ করা হয়. আবার সিঙ্গুর- নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সময়ে যখন আমি দেখি আন্দোলনের ক্ষীর খেয়ে নিজেদের ক্ষমতার জায়গায় প্রতিষ্ঠিত করছে আরও একটি প্রতিক্রিয়াশীল পার্টি, তখন আমি সরে আসি. সে সময়ে আমার নামে যেখানে যা খুশি বলা হয় এবং লেখার জগতেও ব্রাত্য করা হয়. তাতে আমার কিছু এসে যায় না যদিও.
ক্ষমতা এমন এক বিষয়, যেখানে ব্যাক্তির কোনো অস্তিত্ব নেই. অর্থাত ব্যাক্তি সেখানে নিজের কথা বললে, কোনো পক্ষ যদি সে না নেয়, তাহলে তার পক্ষে টিকে থাকা কঠিন. তাহলে ব্যাক্তি কি করবে?
আমার মনে পড়ে যাচ্ছে একদিন ট্রেন'এ করে যাচ্ছি নৈহাটি. একজন ব্যাক্তি গান গাইছিলেন. গান গাইতে গাইতে হঠাত থেমে গিয়ে বলে উঠলেন, দাদা, বারাকপুর পর্যন্ত আমি গায়ক, তার পর থেকে আমি ভিখিরি. আমি জিজ্ঞেস করলাম কেন? বিকট হেসে আমাকে বললেন- বুঝলেন না, বারাকপুর পর্যন্ত আমার পরিচয় এই. তার পর এই পরিচয় অন্য কোনো একজনের. এখন যে ভিখিরি, সে তার পর থেকে কোনো এক দেশী মদের ঠেকের দালাল. কথাটা কতটা সত্যি আমি জানি না, কারণ খতিয়ে দেখতে জানি আমি, কিন্তু আমার মনে হয়েছিল, আমরা প্রায় সকলেই এমনি.
ফিরে আসি ছিন্নপত্রে. আমি মনে করি, প্রতিটি বইকে আসলে আবিষ্কার করতে হয়. একদিন বিকট বিষন্ন হয়ে আমি বাড়িতে বসে দুপুরে রবীন্দ্র রচনাবলী উল্টোচ্ছিলাম. ছিন্নপত্রের চিঠিগুলিতে এসে আটকে গেলাম. পড়ে যেতেই থাকলাম একটার পর একটা চিঠি. সেই অনুভূতির বিস্তার আবার পরে লিখব.
এখন অফিস'এ.
বাইরে দুপুর. নাগ কেশর গাছটা অদ্ভুত নর্তকী হয়ে আছে. অনেক নতুন পাতা গজিয়েছে. অথছ শীত আসছে. কিন্তু গরম কম না! ( ক্রমশ)
Comments
Post a Comment