এলোমেলো-৮


এলোমেলো-৮

শীতের ভিতরে মাথা জমে থাকলে যেমন অবস্থা হয়, আমার এখন তেমনি অবস্থা. বাইরে অদ্ভুত একটা দুপুর. লোকজনের ব্যস্ততা. সকলেই খুব ব্যস্ত. আমিও নিয়মমাফিক কাজ করে চলেছি অফিসে বসে. কিন্তু কি করছি কে জানে! মাঝেমধ্যে মন চলে যায় অনেক দূরে. এই অবস্থা কোনো পেশাদারী জায়গায় বোঝানো অসম্ভব. আমার মনে পড়ে সেই সব মন্থর দুপুর গুলোর কথা যখন আমি শুধু একটি খাতা পেন নিয়ে বুকে বালিশ নিয়ে অপেক্ষা করতাম. ভাবনাগুলিকে লিখে রাখতাম. আর কানে ভেসে আস্ত দুপুরের শব্দ. আমাদের বাড়িতে একটি কাক থাকে. থাকেই বলা ভালো. রাতে বারান্দার দাঁড়ে বসে থাকে. তার দানা ঝাপটানোর শব্দ শুনতে পাই. সকালে মা কাকেদের খাওয়ায়. আমিও তাদের বন্ধিত করি না. সেই কাকটি দুপুরবেলাতে অদ্ভুত সুরে কথা বলে চলে দাঁড়ে বসে. এখনো ছুটির দিনে আমি যখন বুকে বালিশ নিয়ে মন্থর ভাবে জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকি, তখন সেই সব পাখি আমার জানলে উড়ে এসে বসে. কিছু চড়াই আছে. একটা চেনা শালিখ আছে. আর আছে আমার ছোট ঘরটা. 
জীবন থেকে মন্থরতা হারিয়ে গেলে জীবনের অনেক ক্ষতি হয়. আগে মনে হত আমার একটা দিন মানে অনেক দিন. এখন বুঝতে পারি না আমার দিনগুলো কত ছোট সময়ের মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে. এখন আমার এক সপ্তাহ মনে হয় একটি দিন. আবার এই এক সপ্তাহ এক বছর. একই সঙ্গে যেমন অত্যন্ত দ্রুত ভাবে জীবনটা কাটছে, তেমনি অত্যন্ত দ্রুত ভাবে জীবনটা শেষ হয়ে আসছে. খুব আধুনিকতার অন্যতম একটা সমস্যা এইটা. মন্থরতা জীবন থেকে চলে যাওয়া. 
অথচ এমন ভাবেই তো অনেকেরই জীবনটা কেটে যাচ্ছে. তারা আপাত সফল হচ্ছে. কেউ খুব ভালো কপি লেখক হচ্ছে, কেউ খুব খ্যাতিমান কবি, কেউ অধ্যাপক, কেউ ব্যবসায়ী, কেউ ফিল্ম মেকার. কিন্তু মন্থরতা তাদের আর নেই. এই মন্থরতা আমাদের বাঙালিদের জীবনের একটি স্বভাব. বা বলা ভালো বৈশিষ্ট. আমরা নদীর দেশের লোক. নদী যেমন মৃদুমন্দ বয়ে যায়, তেমন. আমরা ধানক্ষেতের দেশের লোক. তাড়া নেই কোথাও যেখানে. পাহাড়ে এই মন্থরতা খুব কাজে দেয়. সেখানে তাড়াহুড়ো করলে শেষ. মজাটাই টের পাওয়া যাবে না. প্রকৃতি আমাদের কাছে যে কথাগুলো শুনিয়ে যায়, সেই কথাগুলিকে অনুসরণ করে বোঝার জন্য প্রয়োজন হয় একাকী থাকার. প্রয়োজন হয় একা হেঁটে যাওয়ার. প্রয়োজন হয় মন্থরতার. বেশি কথা খরচ না করে 
চুপচাপ থাকার. 
কিন্তু আমাকে চুপচাপ থাকতে দিছে কে! আমি চুপ করে থাকতে চাইলেও থাকতে পারব না. এই অফিসের সামনে গাছটার দিকে একটু তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে. পারব না. একটু বাদেই আবার মিটিং. 
আমার পুরনো দিনগুলোর কথাও মনে পড়ে. মোহগ্রস্তের মত যে আমার ভাবনার মত নয়, তার সঙ্গে বন্ধুত্ব করে এবং তার সঙ্গে সময় কাটানোর জন্য কি না করেছি এক সময়ে. তার পর দেখেছি, সবই আমার মনের মায়া. আর সেই মায়ার জালে আমি হারিয়ে ফেললাম যে আমাকে সবথেকে বেশি ভালবাসত তাকে. 
এখন কারোর সঙ্গেই আমার সম্পর্ক নেই. আমি সবার কাছ থেকেই নিজেকে বিযুক্ত করে নিয়েছি. আবার বাধ্যতামূলক ভাবে আমাকে সকলের মধ্যে থাকতে হয়. সকাল সকাল শুনতে হয় এই বোনাস হলো না, এই মাইনে বাড়ল না. এই টাকা কেটে নিয়েছে. আবার কেউ কেউ সব বোঝেন. কবিতা তো সকলেই সহজে বুঝে যায় (!!!!) এই একটি বিষয়ে মন্তব্য করার অধিকার মনে হয় সবার আছে!! বিজ্ঞাপনের লোক কবিতা নিয়ে মহত জ্ঞান দেবেন, সেটা শুনতে হবে; আধ্যাত্মিকতা নিয়ে সিরিয়াস আলোচনা করবেন, তাল মেলাতে হবে; অত্যন্ত কদর্য কিছু রসিকতা করবেন, সেগুলিতে না হাসলে রসবোধ নিয়ে প্রশ্ন উঠবে!
ভাবা যায় না. আমরাই সম্ভবত একমাত্র জাতি যারা শিল্পী মানেই খ্যাতিকে সম্মান করি. শিল্পকে না. খ্যাতি প্রাপ্ত শিল্পী না হলে তিনি সঠিক কথা বললেও তার কথার দাম থাকে না. এক বড়বাজারের মধ্যে আমাদের যাবতীয় শিল্প বিক্রি হয়. শিল্পী বিক্রয় হন. তাদের মাথায় শিরোপা বসিয়ে দিয়ে যান রাজনৈতিক পদবিধারীরা. 
মহা মুশকিল হলো. কী লিখতে শুরু করেছিলাম আর কোথায় এসে পড়লাম!
না. আমি আএত গতিশীল হয়ে থাকতে পারছি না. আমি আরেকটু মন্থর হয়ে যাই. বাইরে আপাত গতিশিলের ভূমিকাটুকু রেখে যে কীভাবে নিজের ভিতরে মন্থর হয়ে যেতে হয়, তা প্রাকটিস করতে হবে. 
অথবা তা এমনি আসবে!
শুধু অপেক্ষা করতে হবে. যদি এই অপেক্ষা মৃত্যু পর্যন্ত চলে!
এই তাই যা ভয়!
(ক্রমশ)

Comments