এলোমেলো আমি-২২


এলোমেলো আমি-২২

আজ এই মহা-অষ্টমীর দিন দুপুরে আমার খুব আনন্দ হলো. আমার তার সঙ্গে কথা হলো. বেশ কয়েকদিন পর. আমার ভিতরে জমে থাকা কত কথাই যে বললাম! কি হয়ে পড়েছিলাম তাই না? আমার জীবনের একটা বিশেষ পর্যায়, যখন আমার নানা কাজ করার সময়, তখন আমি তাকে কতই যে ছোট করেছি. আবার এখন প্রত্যেক মুহুর্তে বুঝতে পারছি যে সেই ছয়টা মাস আমি কীভাবে নিজের কবর নিজেই নিজেই সাজিয়েছি. আর এখন, যখন আমি বেরিয়ে এসেছি আমার সমস্ত খারাপ পর্যায়গুলি থেকে, তখন আমার পাশে সে নেই. কিন্তু সে কি নেই? আছে তো. সেও তো কষ্টে আছে. সে আগেই কষ্টে ছিল. আমাকে খুব ভালবেসেছিল. কিন্তু তার প্রতিদানে আমি তাকে কী ফিরিয়ে দিয়েছি? কষ্ট ছাড়া? তাকে ছোট করেছি. নিজেকে ছোট করেছি. সৎ থাকিনি. আর সেই না সৎ থাকা তাকেও কষ্ট দিয়েছে. আমাকে যে সে খুব ভালবাসত. বড়  দেখা করতে ইচ্ছে করছে তোমার সঙ্গে. আমাকে যদি সে বন্ধু হিসেবেও আরেকটু সময় দেয়, তাহলেও আমি অনেক ভালো থাকব. কি জানি আমার জীবনে কি অপেক্ষা করছে! সে যেন আমার মৃত্যুর সময়ে আমার পাশে থাকে. ঈশ্বরের কাছে এটাই আমার প্রার্থনা. না হলে যে মরতেও পারব না আমি. 
কোনো কোনো মানুষের সঙ্গে কথা বললে মনে হয় গির্জার কনফেসন রুমে বসে আছি. সেখানে সব কথা বলে ফেলা যায়. সে আমার এমনি বন্ধু. তার চোখের দিকে তাকালে এখনো নিজেকে দেখতে পাই আমি. সে আমার কাছ থেকে যায়নি. কোথাও যেতে পারে না. আমি জানি সে যাবেও না. কিন্তু আমি তাকে এভাবে যে ভালবাসি তা আমি আগে কেন বুঝিনি? আগে কেন তুচ্ছ কিছু বিষয়, সামান্য কিছু বিষয় আমাকে তারা করে বেরিয়েছে, যেগুলি থেকে আমি কিছু পাওনি. বেশ ভালো ছিলাম এক সময়ে. জীবনে সরলতা ছিল. ভালবাসা ছিল. জীবনে আশ্রয় ছিল. কিন্তু কোনো মানুষ যদি আত্মহত্যাকামি হয়, তাহলে সে কি কোথাও ফিরতে পারে? সে তো ক্রমশ নিজেকে মারে. অন্য কাউকে কষ্ট দেওয়া মানে তো আসলে নিজেকেই হত্যা করা. এতে কি হয়-- নিজের মধ্যে এক শয়তান জন্ম নেই. শয়তানেরা খুব খারাপ. শয়তান কারো বন্ধু হতে পারে না কখনো. শয়তান যা করে তা হলো জীবন কে ধ্বংশ করে জীবন থেকে হাত সরিয়ে নেই. প্রফেসনাল কিলারের মত. তাকে কে সুপারি দেয় কে জানে!
একবার ভিআইপি রোডে দেখেছিলাম এক অশীতিপর বৃদ্ধ্হের হাত ধরে রাস্তা পার হচ্ছেন এক অশীতিপর বৃদ্ধা. আমার কাছে কামের থাকলে আমি সেটাকে তুলে রাখতাম. এই সময় এরা এদের জীবনের মাঝি এবং এদের শেষ পারানিও. যারা একে অপরের মাঝি এবং পারানি হয়ে সারাজীবন থেকে যায়, তারাই আসলে একে অপরকে ভালবাসে. 
আমার সমস্যা হলো আমি যে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম তখন তা কেউ বুঝতে চায় না. আমাকে যদি আর একবার সুযোগ দেওয়া হত, তাহলে হয়ত আমার জীবন অন্য রকম হত.
কী ভাবে লিখতে পারলেন বিনয়দা ফিরে এস চাকার মত কাব্যগ্রন্থ? কী চরম ভালবাসা ও বোধ থাকলে এরকম কবিতা লেখা সম্ভব! পৃথিবীতে এরকম কাব্যগ্রন্থ খুব কম আছে. আমার কাছে গীতাঞ্জলির থেকে ফিরে এস চাকার আবেদন কোনো অংশে কম নয়. ভালবাসা যে ধর্ম হতে পারে, তাকে আধুনিক দেখার চোখে কী ভাবে আবিষ্কার করতে হয়, তা বিনয়দা হাতে ধরে শেখালেন. তাঁর প্রতিটি কবিতার মধ্যে রয়েছে সেই ঈশ্বরী. ঈশ্বরী প্রসঙ্গে মনে পড়ল আমাকে একবার অরুপদা বলেছিলেন ঈশ্বর নেই, ঈশ্বরী আছে. আমি বলেছিলাম যদি এমন কোনো শক্তি থাকে তবে তার লিঙ্গ থাকতে পারে কি? অরূপ দা আমাকে বলেছিলেন- দেখো, ঈশ্বরী আছেন তার কারণ মহাজগত আছে. ঈশ্বরী আছেন তার প্রমান ভালবাসা আছে. ঈশ্বরী আছেন তার প্রমান সময় আছে, সৃষ্টি আছে, প্রলয় আছে, মৃত্যু আছে. তার পর আমাদের কথাবার্তা চলেছিল যৌনতা ও মৃত্যু নিয়ে. যৌনতার মধ্যে যেমন থাকে মৃত্যুবোধ তেমন মৃত্য এক ধরনের যৌনতা. সময়ের সঙ্গে বিলীন হয়ে যাবার যৌনতা. মানুষের তো জীবনে দুবার মৃত্যু হয়. একটা আপাত সময়ের কাছে আসার সময়ে যখন মায়ের জরায়ু থেকে কোনো শিশু জন্ম নেয়, তখন , সে প্রাণ বা শ্বাস নিতে শুরু করে. কিন্তু সেই বাতাস তো তাকে ছাড়তে হবে. সেই প্রথম বাতাস. মৃত্যুর দীর্ঘশ্বাস এক ধরনের সেই বাতাস ত্যাগ করা. জন্ম হচ্ছে এক যৌনতায়, মৃত্যু হচ্ছে আরো এক যৌনতায়. 
প্রতিটি যৌনতা কি এই মৃত্যু কে অনুভব করার সুন্দর রূপ? যেখানে বিলীন হয়ে যাওয়া আছে. যেখানে আত্মবিলুপ্তি ঘটে. ভালবাসার মধ্যেও তো এই আত্মবিলুপ্তি ঘটে. তাই ভালবাসার সঙ্গে প্রতারণা করা আসলে মৃত্যুর সঙ্গে প্রতারণা করা. মৃত্যু কে আমি কোনো নেগেটিভ অর্থে বলছিনা. মৃত্যু এক অত্যন্ত পজিটিভ বিষয়. আমরা মরতে ভয় পাই, তার কারণ আমরা কেউ এটা অনুভব করতে চাই না যে আসলে 'আমি' বলে কেউ নেই. 'আমি' বলে কেউ ছিলনা কখনো. 'আমি' বলে কেউ থাকবেও না. এই যে কবিতালিখি. একটিও সঠিক কবিতা কি আমার লেখা? প্রতিটি কবিতা, প্রতিটি গান তো চারিদিকে ঘুরছে. প্রকৃতি তৈরী করছে সেই সব অনুভূতিমালা. তাকে তো লিখিত হতে হবে. আমার কাজ হচ্ছে নিজেকে উপযুক্ত ধারক করে তোলা. উপযুক্ত কলম করে তোলা. এই এক একটি লেখাও প্রকৃত অর্থে যৌনতা. সময়ের সঙ্গে যৌনতা. 'সময়ের সঙ্গে এক বাজি ধরে পরাস্ত হয়েছি'- লিখেছিলেন বিনয়দা. 
এই বার রাস্তায় পা বাড়ালেই আমার প্রতিটি পদক্ষেপে আসবে সে. আমার প্রতিটি সময়ে আসছে সে. আমার প্রতিটি মুহুর্তে আসছে সে. তার কাছেই সাজানো আছে আমার সমস্ত নিবেদন. কে 'আমি'? কি 'আমার' ? আমি যদি কোনো লেখা লিখি যা সময়ের কাছে থাকার মত, তবে সেই সময় নামক ঈশ্বরী লিখবেন. আর সেই লেখা লিখিত হবে অদৃশ্য এক শিলালিপি হয়ে সময়ের গহ্বরে. 
কী আছে এই জীবনে? 
আলোকবর্ষের পর আলোকবর্ষ ছুটে চলেছে সময়. এই মহাজগতের শেষ নেই., শুরুও নেই. কেন্দ্র-ও নেই. সে আছে. 
কেউ যদি বলেন তুমি আদ্যন্ত মার্ক্সিস্ট ভাবনায় বিশ্বাসী হয়ে এই সব কথা বলছ কী ভাবে! তাহলে তাকে আমি বলব আমি বলছি না. সময় বলছে. আমার কোনো কোনো অনুভূতি যদি ঈশ্বরী চেতনা হয়ে ওঠে তাতে আমার তো কিছু করার নেই. আমি কোনো ধর্ম পালন করছি না. আমি বলছি না এমন কেউ আছেন যিনি আমার মুশকিল আসন. যিনি আমার দেবতা. যিনি আমার দেবী. আমি এসব কিছুই বলছি না.
আমি সঙ্গমের কথা বলছি. আকাশের সঙ্গে আমার সঙ্গম হয় না? বৃষ্টির ভিতরে আমি কেঁদে উঠি না? মাটির উপর বৃষ্টির সোঁদা গন্ধে আমার মন খারাপ হয়ে যায় না? আমার ইন্দ্রিয়গুলো চনমনে হয়ে যায়না? কোনো মৃত মুখ আমি দেখিনি শান্তি ছাড়া. তেমন কোনো সঙ্গমেই আছে শান্তি. তেমন ভালবাসতেই আছে ঈশ্বরীর সঙ্গলাভ.
আমার স্বপ্নে দেখে সেই দেবীর মত. যে আমাকে নি:শ্বেষিত করে দেবে. যে আমাকে টেনে নিয়ে যাবে শান্ত ভাবে কোনো এক নদী পেরিয়ে যাবার দেশে., আর তাকে যদি পেয়ে যাই কখনো তখন সেই তো কবিতা. 
আমি বুঝতে পারছি আমি ক্রমশ স্নান করছি. আমি বুঝতে পারছি আমি এবার হয়ত অন্য কোনো লেখা লিখতে পারব. শুধু আমার হাত ছেড়োনা কখনো. মৃত্যু, আমাকে সঙ্গে নাও. আমার কাছ থেকে চলে যেও না. তোমার সঙ্গে হেঁটে হেঁটে আমি তোমার মধ্যে বিলীন হব. আমাকে অনুভব করতে দাও তোমাকে. আমাকে তোমার মধ্যে মুখ ডুবিয়ে দিতে দাও. আমাকে গ্রহণ করো. গ্রহন করো. গ্রহন করো. 
(ক্রমশ)

Comments