এলোমেলো আমি-৫


এলোমেলো আমি-৫

এর আগের অংশে আমি যে কথাগুলো লিখলাম, তারই সঙ্গে আমার মনে পড়ে গেল কবি তুষার চৌধুরী -এর কবিতার কথা. একদল বৃহন্নলা কবিতাকে নিয়ে গেছে তাদের ডেরায়. হাহাহাহা. কী অসাধারণ রসবোধ ছিল লোকটার ! মনের গভীর অবচেতনার স্তরে পৌছে গিয়ে লোকটি কবিতা লিখতেন. তিনি দেখেও যেতে পারেন নি, তাঁর কবিতা নিয়ে কোথাও কিছু লেখা হচ্ছে! কিন্তু তাতে তার কি এসে যায়! কবি ভাস্কর চক্রবর্তী, কবি তুষার চৌধুরী, গদ্যকার অরূপ রতন বসু, বাসুদেব দাসগুপ্ত এদের লেখা আমাদের মধ্যে চিরকাল থাকবে. এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে যাচ্ছে আরও দুজন অসাধারণ কবির কথা. তাঁরা শ্রী রমেন্দ্রকুমার আচার্য চৌধুরী এবং দেবদাস আচার্য. আমার সৌভাগ্য যে আমি কিছুকাল অরূপ রতন বসু এবং সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়-এর সাহচর্য পেয়েছিলাম. আচ্ছা, গত কয়েক বছরে ঠিক কতজনের কবিতা বা গদ্য তেমন ভাবে পড়া যায়? বুকে হাত রেখে কেউ বলতে পারবেন? 
লেখা সম্পর্কিত আমার কিছু ভাবনা এখানে লিখি. আচ্ছা কবিতা আমরা কেন লিখি? কবিতা ঠিক কি? গতকাল অনেক রাতে ফিরতে ফিরতে আমি ভাবছিলাম. এই প্রকৃতি, এই চারপাশ, আমাদের মধ্যে এক বোধের হদিস দেয়. সেই বোধ অনুভূতিমালা হয়ে আমাদের মধ্যে থাকে. আমাদের বিপন্ন বিস্ময়ের মধ্যে নিয়ে যায় তখনি যখন আমার ভিতরে থাকা আবহমান অবচেতনার সঙ্গে আমার অভিজ্ঞতার এক সম্পর্ক তৈরী হয়. মানে, আমার বোধের সঙ্গে আমার আমার অপর কোনো অভিজ্ঞতার সম্পর্কের মধ্যে  জন্ম নেয় আরো অন্য কোনো প্রকাশভঙ্গি. এবং সেই প্রকাশভঙ্গি জন্ম দেয় আরো অন্য কোনো বোধের.  অর্থাত এক বোধ থেকে আরো অন্য কোনো বোধের দিকে অভিযাত্রার মধ্যবর্তী অনুভুতিমালাকে যদি প্রকাশ করা হয়, তবে তা কবিতার বা লেখার বা অন্য কোনো শিল্পমাধ্যমের জন্ম দেয়!
এখন সন্ধে বেলা. কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম রাতের আকাশের দিকে. অনেক দিনের মত. কোটি কোটি  আলোকবর্ষ দূরের তারা গুলো চোখে পড়ছে. যখনি আমরা আকাশের দিকে তাকায়, তখনি আমরা একই সঙ্গে অতীত এবং ভবিষ্যত কে দেখি. এই যাবতীয় গান, কবিতা, বোধ এই অভিযাত্রার মধ্যেই লুকিয়ে আছে. হয়ত এখন কারোর বাড়িতে শোক, কেউ হয়ত এই মুহুর্তে শেষ নি: শ্বাস ত্যাগ করছেন. কেউ হয়ত কাউকে চুমু খাচ্ছে, কেউ হয়ত সঙ্গম করছে, আবার কেউ হয়ত না খেতে পেয়ে রাস্তার ধারে পড়ে আছেন. সবই হচ্ছে. সবই নিজের নিয়মমত হচ্ছে. আমার এই মুহুর্তে মনে পড়ে যাচ্ছে একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখেছিলাম পঞ্চলিঙ্গেশ্বরে. সিঁড়িটা যেখানে উঠে গেছে ঝরনার দিকে, সেখানে পড়তি বিকেল বেলা দেখেছিলাম হাজার হাজার গাছ থেকে অসংখ্য পাতা উড়ে যাচ্ছে নীচের দিকে! কী নির্মোহ সেই দৃশ্য!
প্রকৃতি কি স্বভাবত আগুনের মত নির্মোহ?
অনেক দিন কবিতা লিখিনি., তা প্রায় এক বছর হতে চলল. মেডুসার চোখ কাব্য গ্রন্থের পর মন প্রায় নিশ্চুপ. মনে পড়ে গেল এলিয়ট এর কথা. উনি বলেছিলেন, তিরিশের পর কবিতা আর সহজ ভাবে আসেনা. কবিতাকে খনন করতে হয়. আগে বুঝিনি. এখন বুঝি. যখন কবিতা লেখার সময়েই মাথায় আসে, স্বভাব কবিত্ব থেকে আমাকে সরে আসতে হবে. কারণ কবিতা লেখার প্রকরণ, কৌশল আমার জানা. চেষ্টাও করতে হবে না. অনেক কবিতায় এখন সারাদিনে লিখতে পারব. কিন্তু কী লিখব!!!
   অরূপ দা আমাকে একটি কথা বলেছিলেন, 'কবিতা হলো ঈশ্বরীর মত. তাকে জানতে হবে' এ প্রসঙ্গে একটি অদ্ভুত অনুভূতি লেখার লোভ সামলাতে পারছি না. কবিতা আমার কাছে অনেকটা নিয়তির মত. আমি দেখেছি যখন আমার জীবন খুব ভালো ভাবে চলে, যখন খুব ভালবাসার মধ্যে আমি আছি, তখন তা হারিয়ে ফেলার অনুভূতি আমার মধ্যে কাজ করে. কবিতা লেখার ক্ষেত্রে আমি পরবর্তী সময়ে চলে যাই, যেখানে আমার সঙ্গে কেউ নেই. আমি আগামী সময় কে দেখতে পাই. আর যে গুলো আমার কবিতায় লিখি, সেগুলি আশ্চর্য ভাবে আমার জীবনেও ঘটে যায়, এমন সব ঘটনা ঘটে, যে সেগুলি যে ঘটবে, তা আমার কল্পনাতেও আমি ভাবিনা কখনো! কিন্তু ঘটে যায়!
তাই কবিতা লিখতে আমি কিছুটা ভয়ই পাই. 
আমি জানি এই ভয় অমূলক. হয়ত সবই সমাপতন. হয়ত এটাও আমার কল্পনা. বা হয়ত এসবি অন্য কারোর স্বপ্ন. কেউ হয়ত স্বপ্ন দেখছে আমাকে আর আমি তার স্বপ্নের একটা চরিত্র মাত্র. তার ঘুম ভাঙ্গলেই আমি মরে যাব!
কথা থেকে কোথায় এসে গেলাম! 
শেষবার যখন দীঘায় গেছিলাম, তখন আমি নীচে বসে ছিলাম ওই পাথরের স্ল্যাব গুলোর উপর. আর সমুদ্রের ঝড়ের ঝাপটা খেয়ে উল্টে পড়ে গেছিলাম. 
আমি একটা সময় বরানগরে পরাতে যেতাম. তখন তো সুধু পরতাম. তুমি, অরক্ষিত কাব্যগ্রন্থে সেই বরানগরের কথা আছে. সেই সময়েই অনেক দিন কখনো মৃদুলদার সঙ্গে, কখনো ভাস্করদার সঙ্গে আমার আড্ডা চলত. সেই যে দমদম থেকে বরানগরের রাস্তাটা, যেটা আমি বিকেল্বেলাগুলোতে হাঁটতাম, নাকে আসত বিভিন্ন গাছের গন্ধ, আমার অদ্ভুত মৃত্যুচিন্তা আসত. ওই যাওয়ার পথে একটা জায়গায় অদ্ভুত সুন্দর পুকুর আছে একটা. আমি সেই পুকুরের ধারে মাঝেমাঝে বসে থাকতাম. দেখতাম সূর্যাস্তের রং জলের উপর কীরকম পড়েছে! ঝুপ করে অন্ধকার নেমে আসত. মনে হত আমার সঙ্গে সঙ্গে কেউ চলেছে! 
তার পর তাকে আমি চিনতে পেরেছিলাম.
সে হলো কবিতা.
এমন কিছু অভিজ্ঞতা আমার জীবনে বারবার ঘটেছে. যখন আমায় কিছু লিখতে হয়নি. লেখা আপনা থেকে আমার কাছে এসেছে. লেখা লিখিত হয়েছে. একটা ঘোর, যা লেখাকে জন্ম দেয়, সেই ঘোর এমনি এমনি আসে না. আসে সেই সব মনে, যে মন নিজেকে ভুলে যায়. তখন সেই মনে কবিতা নিজেকে লিখতে শুরু করে.
এমন হয়, যখন আমি ইন্দ্রজিতদাদের সঙ্গে বাংলার মসজিদগুলো ঘুরতে যাই. গৌর, পান্ডুয়া, হেমতাবাদ, বিন্দোল-এর সেই সব পুরনো টেরাকোটার মসজিদ এবং মন্দির গুলি আমাকে যে কোথায় নিয়ে গেল আমি নিজেই জানি না. টেরাকোটার ভাস্কর্যের মধ্যে লুকিয়ে থাকা নানা গল্প, প্রায় বিস্মৃত হয়ে যাওয়া শব্দ, ছোট ছোটগল্পগুলো আমার মাথার মধ্যে এক কুহকি বাস্তবতার জন্ম দেয়. আমি চলে যাই সেই সব সময়ে. সমসময়ের কথাও চলে আসে. হঠাত মনে হয় সমসময়ে পক্ষহীন শিল্পী আর এই সব টেরাকোটার শিল্পীদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই. 
জগতগৌরী কাব্যের এক একটি সনেট আমার এভাবেই লেখা. 
কিন্তু যা বলতে চাইছিলাম তা কোথায় গেল?
আমার বারবার মনে হয়, যে বাস্তবতার প্লেন এ আমরা বসবাস করছি, তার পাশাপাশি আরও একটা বাস্তবতা আছে. হয়ত আমি-ই আছি. কিন্তু সেখানে সম্পূর্ণ অন্য কোনো কাজ করছি. বা আমার সত্তাটি-ই আছে অন্য কোনো সময়ের ফ্রেম-এ. তার সঙ্গে যোগাযোগ যখন হচ্ছে, তখন গুলিয়ে যাচ্ছে সব. গুলিয়ে যাচ্ছে না, বলা ভালো অনেকরকম আমির সঙ্গে কথোপকথন তৈরী হচ্ছে. নিজে বিযুক্ত হয়ে যাচ্ছি আমার আপাত বাস্তব দশার থেকে!
এই ঘোর লাগা পরিস্থিতির জন্য দরকার হয় নিজের সঙ্গে নিজের একা থাকার. কিন্তু আমি জীবন দিয়ে বুঝেছি আমার এই ঘোর লাগা অবস্থাতে অনেকে আহত হয়. আমাকে মুর্খ এবনং সামাজিক হিসেবেই দেখতে তাদের ভালো লাগে. কিন্তু আমি তো তা পারব না. তাই আমার সারাজীবন হয়ত কেটে যাবে এভাবেই. কিছু কবিতা না লিখলেও. তার পর একদিন মরে যাব. মরে যাওয়া মানে ফুরিয়ে যাওয়া কিনা সে তর্কে যাচ্ছি না. কারণ আমি এ বিষয়ে কিছুই জানি না. 
আমি এখন সত্যি অনেক উল্টোপাল্টা লিখলাম. কিন্তু অরূপ দা আমাকে এটাই বলেছিলেন. তিনি বলেছিলেন- তোমার জীবন কখনই শান্তির হবে না. 
কে জানে! এখন দিনের অধিকাংশ সময় তো কেটে যাচ্ছে কিছু মেকি বিষয় লিখতে লিখতে. বিজ্ঞাপন লিখতে লিখতে. সেটাও এক শিল্প. কিন্তু সেই শিল্প আমাকে খেতে দেয়. আমি সৌভাগ্যবান আমাকে বুঝতে পারেন একটি লোক. আমার কাজের জগতে তিনি আমার সিডি. আমার বস. কিন্তু তার বাইরেও তার এক পরিচয় আছে! 
তিনি সুগত গুহ. তার কথা আবার পরে লিখব. এখন মাথা আবার ক্লান্ত হয়ে আসছে. একটু মোজার্ট শুনব আর তার্কভস্কি-এর ছবি দেখব. 
কিছুদিন আমি যদি কোনো কথা না বলে চুপ করে থাকতে পারতাম! (ক্রমশ)

Comments

  1. bananbhulguso sajhyo kora jachhe na....ei transliteration majhemajhe je ki kore

    ReplyDelete
  2. তুমি "অভ্র" ব্যবহার ক'রছো না কেন?

    ReplyDelete

Post a Comment