এলোমেলো আমি-১৬


এলোমেলো আমি-১৬ 

আজ ঘুম থেকে উঠেই মন বড় ভারী হয়ে আছে. এই এমন সুন্দর পৃথিবী, এই বিশাল জগত, কত বড়, একে ছেড়ে যাওয়াটা খুব কষ্টকর. আমাদের জীবনের সাফল্য-ব্যর্থতা, ভালো থাকা,খারাপ থাকা, এগুলো খুব বড় কোনো বিষয় নয়. আমি হঠাত করে আমি হয়ে জন্মেছি, পৃথিবীতে আছি, আমি ভাবতে পারছি, কবিতার মত একটি বিষয় আমার সঙ্গী হয়ে ছিল এতদিন, আছে, অথচ আমার নিজস্ব সমস্ত পরিচয়ই কি সেই বিষয়কে কেন্দ্র করে? বিজ্ঞাপন জগতে কাজ করছি, আমার পরিচয় কি বিজ্ঞাপন জগতের মধ্যে? আমি কে? কিছুই না. নাথিং. ঘুম থেকে উঠেই মনে হলো অনেক হলো বিভিন্ন জায়গায় নিজেকে প্রমান করার যুদ্ধ. আর না. কোথাও না কোথাও থামতে হয়. এই থামাটাই আসল. যাওয়াটা যেমন প্রধান, থামাটাও প্রধান. দেখতে তো পাচ্ছি, পৃথিবী আপন নিয়মে আমার কবিতাগুলিকে প্রকাশ হবার পথে অন্তরায় সৃষ্টি করে দিয়েছে. সকলেই আমাকে ভুলে গেছে.এর ভালো দিকটা হলো আমিও তাদের ভুলতে পারব. আর আমার নিজের জন্য বাজে বকতে আর পারছি না. সেদিন সৌরিশ এসেছিল আমাদের অফিসে. একসঙ্গে ফেরার পথে জানালো প্রচ্ছদের কাজ করতে গিয়েও কত লোকে কত নতুন মানুষের কাছ থেকে তাকে শুনতে হয়েছে শত্রু- এই বিশেষণ. তবু অর কাজ তো প্রকাশ পেয়ে চলেছে. ওকে লোকে ডাকছে. তাহলে কী আমার মধ্যে আমাকে নিয়ে এমন কোনো সমস্যা আছে চারিদিকে, যে লোকে আমার কবিতাকে আর শ্রদ্ধাই করছে না. ভুলে যাচ্ছে? এই যে এক রাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছি, আমার মনে হয়, স্বাভাবিক মৃত্যুগুলিকে মেনে নেওয়া ভালো. মেনে নেওয়া ভালো তুমি এই সময়ে শেষ হয়ে গেছ. যা লিখেছ, লিখেছ, যা পাবার পেয়েছ, এবার তোমার বিদায় নেবার পালা. এটা জগত চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে. এটাও দেখিয়ে দিচ্ছে, তোমার লেখার আসলে কোনো প্রভাব নেই. তুমি জোর করে তো আর লোকজন কে তোমার ভাবনা পড়াতে পার না. নিজে লিখতেও পারছ না এ জন্য. তাহলে ব্যাপারটা কি দাঁড়ালো? বাইরে থেকে রিজেকশন এবং ভিতর থেকেও রিজেকশন. যে বিষয় তোমার বাইরে ও ভিতর থেকে বেরিয়ে যায়, সে বিষয় আর নেই. তাকে তুমি জাতি আত্মা ইত্যাদি বলে থাক না কেন! আসল কথা হলো তুমি এখন শেষ. তোমার অনুপস্থিতি কারোর কাছে অনুপস্থিতি-ই নয়.
তাহলে তোমার করার কী আছে? যে কাজের জন্য পৃথিবীতে এসেছিলে,পৃথিবী জানিয়ে দিচ্ছে যে তোমাকে আর দরকার নেই. তুমি ফোটো! তুমি বিদায় নাও. এর পর তোমার বাকি থাকলো কি? তোমার স্মৃতি. তোমার দু:খ, তোমার নেশা, তোমার নি:শ্বাস, তোমার ইন্দ্রিয়, তোমার মৃত্যু. 
আমি ভেবে দেখলাম আমার জীবনে মৃত্যু ছাড়া আর কিছুই অপেক্ষা করে নেই. 
আমিও তার জন্য অপেক্ষা করে আছি.
কী বললে তুমি ভালবাসতে পারছ না? সে তো জানা কথা. তোমার পক্ষে ভালবাসা সম্ভব নয়. 
কী বললে তুমি ঘুরে বেড়াতে পারছ না? সেও তো জানা কথা. এবার পচে মর.
কী বললে তুমি ক্লান্ত. তুমি রোজ মুখোশ পরে থাকতে পারছ না? আর কদিন আছে ভাই?
কী বললে তুমি লিখতেও পারছ না? লিখ না. কে বলেছে তোমাকে লিখতে হবে? কেউ তোমার লেখার জন্য অপেক্ষা করে নেই.
কী বললে তুমি চাও সবার কাছ থেকে দূরে সরে যেতে চাও? তো দূরেই আছ. তুমি কবে কাছাকাছি গেছ?
কী বললে জীবনটাকে নিয়ে কী করবে বুঝে উঠতে পারছ না? আরে বাবা মৃত্যু শুধু আছে এখন. তোমার জীবনে একমাত্র নতুন ঘটনা হচ্ছে মৃত্যু. তোমার স্বীকৃতি হচ্ছে মৃত্যু. সে কি সহজে আসে? তার জন্য সময় দিতে হয়. ওই তোমার লেখার মত. 
তাহলে কী করবে? নিজের জীবনটাকে এভাবে ব্লগ এ লিখছ কেন? তা আবার লোকজন কে পড়াচ্ছ কেন? নিজের সঙ্গে কথা তো বল. অন্য কথা বল. নিজের সম্পর্কে ভাবা ছেড়ে দাও. আরে দেখেছিলে তো জীবনে কি কাউকে তুমি ধরে রাখতে পার?
যে যাবার সে যাবেই. 
সংযুক্ত থাকলে বিযুক্ত হতে হবেই.
আর সেই ছিঁড়ে যাবার বেদনাটাও সত্যি করে পেতে হবে.
মন মানতে চাইবেনা. 
কিন্তু মন একদিন সয়ে নেবে.
তুমি একা এসেছ. একা চলে যাবে.
কী দরকার কি তোমার ফেসবুক করার? এই এত লোক, এদের সঙ্গে কথা বলার? তাদেরকে লেখা পড়ানোর?
দেখতেই তো পছ, পত্রপত্রিকাগুলি তোমার লেখা চায়না আর. 
তুমিও লিখতে পারছ না.
সে সবের জন্য অন্য ধরনের লোক হতে হয়. তাদের একটা সমাজ আছে. সেই সমাজের অংশ হতে হয়. 
তুমি কিছুই কর নি. 
কিছুই করবে না.
তোমার জন্য যদি কারোর অপেক্ষা না থাকে জানবে তুমি সেখানে অনাগত অতিথি.
লেখালেখির জগতে তুমি অনাগত অতিথি.
এবার নিজেকে ভুলে যাও.
আউটসাইডার পড় নি?
তুমি কাজের জগতে আউটসাইডার, লেখালেখির জগতে আউটসাইডার, ভালবাসায় আউটসাইডার, পরিবারে আউটসাইডার, এই শহরে আউটসাইডার, নিজের কাছে আউটসাইডার, তো এখন তুমি কি করবে বল. 
তুমি বরং ভুলতে শেখ.
এইসব ফেসবুক ইত্যাদি থেকে নিজেকে সরিয়ে নাও.
মোবাইল হারিয়ে যাওয়ায় এমনিতেই তুমি অনেকের থেকে বিছিন্ন. এখন দেখো মোবাইল থাকলেও তোমাকে কারোর প্রয়োজন নেই.
মানে তোমার রিজেক্ট করার আগে প্রকৃতি তোমাকে রিজেক্ট করে দিয়েছে.
কি? বমি পাচ্ছে তোমার?
সে তো পাবেই.এখনো ঘোর কাটেনি. এক সঙ্গে পাঁচটা স্ট্রং ঘুমের ওষুধ খেলে এমন হয়. 
বাজে বকছো.
সময় এসে গেছে নিজেকে রিজেক্ট করার.
কী ভাবে করবে?
গোল্লায় যাও. 
যদি না মরতেই পার , তবে কি করবে?
তোমার বাবা যা করেছিলেন.
সব কিছু থেকে সরিয়ে নাও নিজেকে. হাসিও পায়. সরিয়ে তো দিয়েছেই তোমাকে সব কিছু থেকে. এই সব বই, নতুন বই ইত্যাদি করে লাভ কি? বোকা....একটা কেউ পড়ে না. যারা বলে পড়েছি তারা আদতে মিথ্যে বলে. 
কেন পড়বে তোমার লেখা? 
বলছি তো তুমি বিলুপ্ত. মানুষের মন থেকেই বিলুপ্ত. কী বলছ নতুন করে লিখছ! কিন্তু পাঠাতে পারবে না নিজের থেকে? কেন তুমি কে বাল?
যার ছটা বই করেও কোনো প্রভাব নেই, অন্তত বিভিন্ন কাগজের সম্পাদকেরা যাকে তার পরেও পছন্দ করে না, তার আরও লিখে বই বের করার মানে কি?
কাকে দেবে তোমার এখন কার লেখা?
সেই সব সম্পাদকেরা তো পড়বেই না. 
সাহিত্যের আড্ডা গুলিতেও তোমার কিছু করার নেই.. ডাক নেই. মোট কথা তোমার কোনো সমাজ নেই, পক্ষ নেই, প্রতিপক্ষ নেই, বন্ধু নেই, কিছুই নেই. সুতরাং তুমি তো রাজা!
বই তি বের করতে যেও না, ওসব এখন কেউ পড়ে না.
তোমার কোনো গসিপ থাকলে লোকে আলোচনা করবে.ঘটনা ঘটিয়ে যেতে পারলে তোমাকে লোকে পাত্তা দেবে! হাহাহাহাহাহা! বাংলা সাহিত্য সমাজ! 
আর কি করবে? আচ্ছা তোমার মাথায় একটা সময় চুল ছিল. এখন নেই. বাবা ছিলেন, এখন নেই. ভালবাসা ছিল. নেই. 
নিজের মনের মধ্যে ঢোক.
তার পর নিজেকে ভুলে যাও. অপেক্ষা করে থাক মৃত্যুর জন্য. আর দেখো. সকল দেখো, বিকেল দেখো, মানুষগুলোর হাসির ভিতরে বিষাদ, বিষাদের ভিতরে হাসি দেখো. 
বাজার-এ যাও. ভিড়ের মধ্যে ঘুরে বেড়াও. 
মৃত্যু আসছে. একটু সময় দাও তাকে. অনেক রাস্তা পেরিয়ে তাকে আসতে হবে. জানলা দরজাগুলো খোলা রাখো. তোমার বইগুলো আর অপ্রকাশিত লেখাগুলো গুছিয়ে রাখো. ওগুলোকে ব্যান্ক এর লকারে পুরে রাখো. 
মৃত্যু আসছে. তাকে বারবার ডেকে বিরক্ত কোর না. তাহলে কিন্তু সেও আসবে না. তোমাকে বাঁচতে হবে এভাবেই. আর যদি কিছু ভালো না লাগে তবে পেটের জন্য যা করছ তা ভালোভাবে করে যাও. সকলের থেকে দূরে সরে যাও. লেখার কথা ভেবো না. যা হয়েছে তার ফল তো তুমি দেখতেই পাচ্ছ. লেখা দিতে বললেও লেখা দিতে পারছ না. লিখতেও পারছ না. আর কেউ তোমাকে দিতেও বলছে না. তোমার বন্ধুবান্ধব রাও সরে গেছে.
তুমি আছ আবার একই সঙ্গে নেই.
তুমি বেঁচে আছ  আবার একই সঙ্গে মরছ.
আকাশের দিকে তাকাও.
সব দূরে সরে যাচ্ছে. 
তুমি কে ভাই?
(ক্রমশ)

Comments