এলোমেলো আমি-৬


এলোমেলো আমি-৬

গতকাল-ই কল্পর্ষিকে গালাগাল দিলাম কবিতা না লেখার জন্য. ওদিকে মণির পান্ডুলিপি তৈরী থাকলেও বইটা বেরোচ্ছে না. কেন যে জানি না! আমার নিজের জীবনেও ঝড় চলছে বলা যায়. আমার একটা অসুবিধের দিক হচ্ছে আমি আমাকে যে ভালবাসে, আমি তাকেও সময় দিতে পারি না. আমার কোনো সম্পর্কই টিকে থাকে না. এর কারণ কি? আমি কি খুব খারাপ মানুষ? এই বয়েসে এসে পিছনে তাকিয়ে দেখতে পাচ্ছি এমন অনেক কিছু জীবনে ঘটিয়েছি, যেগুলি আমার নিজের জীবনেই বুমেরাং হয়ে ফিরে এসেছে. অথচ আমি নিজে জানি আমার সেই সব কাজ করার ক্ষেত্রে কোনো ব্যাক্তিগত স্বার্থ কাজ করে নি. সমস্যাটি হলো আমি চালিত হই আমার মন যেভাবে চায়, সে ভাবেই. আর তার প্রভাব পড়ে স্বাভাবিক ভাবেই আমার জীবনে. তার প্রভাব পড়ে অন্যান্য মানুষের মধ্যেও. এই যে গতকাল আমি ঘোরের কথা বলছিলাম, তার জন্য দরকার হয় আমার নিজের সঙ্গে নিজের থাকার. আমার জীবন কখনই মসৃন পথ ধরে এগোয়নি. এই যে বয়সে এসে পড়েছি আমি, মাঝেমধ্যে নিজেরই আশ্চর্য লাগে কীভাবে! কীভাবে কেটে গেল বেশ কয়েকটা বছর! আমি ভেবে দেখলাম, এই কয়েক বছরে আমি সত্যি সত্যি কিছু কবিতা লেখা আর কিছু গদ্য লেখা ছাড়া আর কিছুই করিনি, যে করে আমি নিজে শান্তি পেয়েছি, আমার ভালো লেগেছে. 
কিন্তু কবিতা-লেখা নিয়ে থাকতে চাওয়া মানুষের জীবন কী এভাবেই যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে যায়? আমি যখন শুধু পড়াতাম, তখন একজনের সঙ্গে আমার আলাপ হয়, এবং আমাদের মধ্যে একটি প্রেমের সম্পর্ক-ও তৈরী হয়. তার নাম এখানে নিচ্ছি না. তো, সেই মেয়েটি আমাকে বেশ চিঠি লিখত. নানা কথা হত. আমার জীবনে আসতে চেয়েছিল মেয়েটি. তখন মেয়েটির অবস্থা ছিল পাগলের মত. আমিও তাকে খুব ভালবাসতাম. তার যার পর নাই জেদের বশবর্তী হয়েই একদিন আমরা স্পেসাল ম্যারেজ এক্ট-এ বিয়ে করি., মেয়েটি চলে যায় বাড়িতে. তার কিছু কাল পরে আমি রেডিয়েন্ট-এ কপি রাইটার-এর কাজ পাই. সেই আমার প্রথম চাকরি করা শুরু. সময়টা ২০০৪. কিন্তু তার কিছু কালের মধ্যেই মেয়েটির বাবা-মা আমাকে বলেন এই বিয়ে তাঁরা মানেন না. আমি প্রথমে ভেঙ্গে পরলেও যেদিন সয়ং সেই মেয়েটির মুখ থেকে শুনি সে আমার সঙ্গে থাকতে চায় না, তখন আর যুদ্ধ করা শোভন মনে করিনি. আমাদের বিয়ে অবৈধ হয়ে যায়. 
ভেঙ্গে পড়লেও উঠে দাঁড়ায় কবিতার জোরে. আমাকে ভাস্করদা বলেছিলেন আমাকে লিখতে হবে. 
যে জায়গায় আমি চাকরি করতাম, সেখানে ক্রিয়েটিভ কাজ বলতে কিছুই ছিল না. খুব কম মাইনেও পেতাম. কিন্তু পরিশ্রম ছিল. লেখা চালু ছিল. সেখানে চাকরি করতে করতেই আমি আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রচুর লিখতাম. সেখানে আমার চাকরি যায় আমার রাজনীতির জন্য. যখন সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম আন্দোলনে আমি তত্কালীন সরকারের বিরুদ্ধে নানা জায়গায় লিখছি. মিছিল সংগঠন করছি. এই প্রসঙ্গে আমার মনে পড়ে গেল একদিনের ঘটনার কথা. জি ডি বিরলা সভাঘরে আমার স্রীজাতর, পারমিতা এবং সুবোধ দার কবিতা পাঠ ছিল. সেদিন তা ছিল ১৪ মার্চ এর পরের দিন. 
আমি কবিতা পড়তে যাবার সময়ে, কবিতা পড়ার আগে বলি পশ্চিম এশিয়ার শান্তি নিয়ে কথা বলার আগে বলা উচিত পশ্চিমবঙ্গের কথাও. এতে সেখানে উপস্থিত রবিন দেব সহ সিপিএম এর নেতারা আমাকে ঘিরে ধরেন. প্রায় মারেন আর কী! কিন্তু সেখানে ছিল আমার বন্ধু প্রসুন. প্রসুন না থাকলে সেখান থেকে বেঁচে ফিরে আসতাম কিনা সন্দেহ. সুমন ভট্টাচার্য-ও ছিল.
তো যাই হোক, চাকরি যায়. সে সময়ে ইন্দ্রজিতদার সুত্রে আমার আলাপ হয় গার্গীর সঙ্গে. গার্গী অদ্ভুত ভালো মানুষ. আমাকে খুব ভালো বেশে ফেলে গার্গী. আমিও গার্গীকে খুব ভালোবেসে ফেলি. গার্গীর বাবা-মা থাকেন হাওড়াতে. কিন্তু গার্গী থাকত ইন্দ্রজিত দা, বর্নালিদির সঙ্গে. বলতে গেলে গার্গীর বাবা-মা তাঁরাই. তাঁরা না থাকলে গার্গী এক অন্ধকূপ থেকে বেরোতে পারত না. সেই গার্গী অনেক সংকটের সময়ে আমাকে জড়িয়ে রেখেছিল. কিন্তু আমি পারতাম না আমার নিজস্ব একাকিত্বের বৃত্ত ছেড়ে মিশে যেতে! কিন্তু অদ্ভুত ভাবে দেখেছিলাম আমার সঙ্গে গার্গীর মিল. আমার প্রতি মুহুর্তের মনোভাব গার্গী বুঝতে পারত. অসম্ভব ভালো কবিতা লেখে গার্গী. ইংলিশ -এ. নিজে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট. এখনো কোনো কলেজ এ চাকরি পায়নি হয়ত. 
ছোটবেলা থেকে আমার একটা বদ স্বভাব হচ্ছে নানা বিষয়ে অকারণ মিথ্যে বলার. 
সেই স্বভাবের বলি কেউ হবেন এটা আমার কল্পনার বাইরে ছিল. 
কিন্তু সেই মিথ্যের বলি হলো গার্গী.
আমার যে জগতগৌরী কাব্য বীরেন্দ্র পুরস্কার পায়, সেই বইটি বেরোত না যদি না বর্নালিদি নিজে এগিয়ে এসে চাইতেন সেই বইটি বেরোক. বইটির পাতায় আছে গার্গী, বর্নালিদি, ইন্দ্রাজিত্দার স্নেহস্পর্শ. আছে গোপিদার অসম্ভব ভালো কাজ.
খুব ভালো ছিলাম আমরা. আমার যেকোনো শরীর খারাপের সময়ে গার্গী আমাকে বুকে জড়িয়ে রাখত. কিন্তু আমি তার সঙ্গে মিথ্যাচরণ করলাম. 
অনেক চেষ্টা করেছিলাম. অনুরোধ করেছিলাম গার্গীকে আমাকে ক্ষমা করে দিতে. কিন্তু গার্গী আমাকে ক্ষমা করে দেয়নি. আমাদের ডিভোর্স হয়ে যায়.
আজ যখন একলা বাড়ি ফিরি, আমি বুঝতে পারিনা আমি কার জন্য ফিরছি! নিজেকে নিজে মিথ্যে বলেছি সে সময়ে. কিন্তু এ কথা তো ঠিক, আমাকে যদি সত্যি কেউ প্রাণ দিয়ে ভালোবেসে থাকে, কেউ যদি চেয়ে থাকে আমি লিখি, তো সে গার্গী.
সেই গার্গী এখন আমাকে ঘৃণা করে, যেমন তুমুল ভালবাসত একটা সময়ে তেমনি তুমুল ঘৃণা করে, কিন্তু তার সঙ্গে আমার নাড়ির সম্পর্ক. আমি জানি এ সম্পর্ক কখনই বার হয়ে যাবে না. কখনই আমরা ভুলতে পারব না একে অপরকে, আমার শুধু একটি-ই কথা রাখতে পারত গার্গী, আমাকে আর একবার সুযোগ দিতে পারত. 
কি করেছিলাম তা আবার পরে লিখব. কিন্তু এটাও ঠিক আমার থেকেও অনেক গর্হিত কাজ করে মানুষ ভালো আছে. আমি কিন্তু তুলনামূলক ভাবে যা করেছি, তা অনেকের অপরাধের থেকে কম. আমি কিন্তু তেমন মানুষ নই. আমি এখন রোজ মরছি. 
এমনকি আমি এখন লিখতেও পারছি না. 

জীবনে যারা এসেছে তারা সকলেই আমাকে প্রথমে বলেছিল তুমি লিখবে, শুধু লিখবে, আর অন্য কিছু করবে না. সত্যি আমি অন্য কিছু করতে চাইও না. কিন্তু কী এক জীবন কাটাচ্ছি! 
সকলেই আমাকে ছেড়ে চলে যায়! কী করব! কি করব? আমি যে সত্যি লিখতে চাই. স্বার্থপরের মত বলছি আমি সত্যি লিখতে চাই. 
যেমন ভাবে আমি বেঁচে আছি এখন, তাতে আমার না বেঁচে থাকলেও চলে.
(ক্রমশ)

Comments

  1. মন খারাপ হয়ে গেল লেখাটা পড়ে। তোমার ভাল হোক হিন্দোল।

    ReplyDelete

Post a Comment