এলোমেলো আমি-২৩


এলোমেলো আমি-২৩ 

সুনীলদা চলে গেলেন. ঘুম থেকে উঠেই খবরটা পেয়ে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না. খুব কষ্ট হচ্ছিল. এ কথা ঠিক যে আমার তাঁর সঙ্গে তেমন ঘনিষ্ঠতা ছিল না. মাঝেমাঝে কথা হত ফোনে. তিন-চারবার তাঁর বাড়িতে গেছি আমার বই দিতে. উনি আমাকে কৃত্তিবাসের জন্য লেখা দিতে বলেছেন. পাঠিয়ে দিয়েছি. দু-একবার ফোনে আমার কবিতার বই এবং আমার কবিতা সম্পকে তাঁর প্রশংসাও শুনেছি. তবে কবিতা বা সাহিত্য নিয়ে খুব একটা আলোচনা হত না আমার তাঁর সঙ্গে. আমি দুর্ভাগায় বলা যায়. কিন্তু এটাও ঠিক একধরনের অভিভাবকহীন মনে হচ্ছে এখন. আমার কাছে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কোনো মৃত ব্যাক্তি নন. আমার কাছে তিনি জীবিত. কারণ আমার তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ কবিতায়, উপন্যাস পাঠে. তাঁর কিছু অনবদ্য ছোট গল্প আমাকে মুগ্ধ করে রাখে. কিন্তু যা আমাকে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করে রাখে তা হলো তাঁর কবিতা. আমি যতবারই তাঁর কবিতা পরেছি, ততবারই চুম্বকের মত ভেসে গেছি. কোথাও কোথাও মনে হয়েছে এই কথাগুলো তো আমার! ভাস্করদার কবিতা কিন্তু আকাশ থেকে নেমে আসেনি. ভাস্করদা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন সুনীলদার কবিতার দ্বারা. এমনটাই আমার বিশ্বাস. অন্তত ভাস্করদার প্রথম কাব্যগ্রন্থের বিভিন্ন জায়গায় দেখতে পাই সুনীলদার কবিতার ছায়া. অবশ্য প্রকৃত বড় কবির মত ভাস্কর দাও নিজের ভাষাকে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন কবিতার অন্তর্গত বিপন্ন জগতে. ঠিক সে রকমই সুনীলদার কবিতার মধ্যেও আছে ভালবাসা আর বিপন্নতার এক নাগরিক বিস্ময়বোধ. আত্মকথার মত সেই সব কবিতাগুলি আমাদের ভালবাসতে শেখায়. বাঁচতে শেখায়. আবার নিজেকে তাচ্ছিল্য করে যেমন তেমন খুশি বাঁচতেও শেখায়. আসক্তির মধ্যে দিয়ে নিরাসক্তির দিকে যাওয়ার এক অসামান্য কাব্যপ্রতিভা ছিল এই কবির. আমার বিশ্বাস এই কবির কবিতা নিয়ে আমরা আরও কথা বলতে পারব এবং আরও খনন করতে পারব. তাঁর কবিতায় আছে সেই ব্যাক্তিত্ব, যার খোঁজে কবি সারাজীবন মাথা খুঁড়ে মরেন. মানুষ হিসেবেও এমন প্রশান্ত মানুষ আমি দেখিনি. তিনি একজনকে বলেছিলেন- রাগ কোরনা এত. রাগ করলে লিখবে কি করে! পর্বত যেমন থাকে নীরব অথচ বাঙ্ময়, তেমনি ছিলেন সুনীলদা আমাদের কাছে. তাঁর সঙ্গে আমার শেষ দেখা হয়েছিল রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে. একটি কবিতা পাঠের আসরে. সে ছবি আমার ব্লগ এ আছে. সেদিন সুনীলদাকে খুব অসুস্থ লাগছিল. কোথাও একটা যাবার তাড়া ছিল. তিনি সেদিন পড়েছিলেন আমার ভালবাসার কোনো জন্ম হয়না মৃত্যু হয় না. সুনীলদার উদ্দেশ্যে আমারও একই কথা বলার.
দুর্ভাগ্যবশত তাঁর শেষ যাত্রায় আমি যেতে পারলাম না. আসলে আমি খুব অসুস্থ থাকে বিছানা থেকেই তিন-চার দিন উঠলে কষ্ট হচ্ছে. কাজের কারণে আমাকে মাঝেমাঝে এই কম্পিউটার নামক যন্ত্রের সামনে বসতে হচ্ছে. এভাবেই তাঁর মৃত্যুর দিন লিখে ফেলেছিলাম আমার শ্রধ্যার্ঘ্য. রক্তপাত বলা চলে তাকে.
আসলে মনের মধ্যে সেই সেদিন থেকে ক্রমাগত রক্তপাত-ই হয়ে চলেছে. 
আজ অসংখ্য কাগজে নানা বৃত্তান্ত পড়লাম. শঙ্খবাবুর অসামান্য লেখা আনন্দবাজার'এ এবং এই সময়ে. একই সঙ্গে পড়লাম কবীরদার লেখা. তাঁর সুনীলদাকে নিয়ে লেখা গান. মনটা ভারী হয়ে আছে. পাশাপাশি তসলিমা নাসরিন নামক লেখিকার কান্ডজ্ঞানহীন লেখাটি পড়ে অত্যন্ত বিরক্ত লাগলো. কেন যে কাগজের সম্পাদকেরা এই লেখিকাকে গুরুত্ব দেন কে জানে! 
সহিষ্ণুতা আমাদের বাঙালিদের মধ্যে খুব কমে যাচ্ছে. সুনীলদার মধ্যে ছিল সেই সহিষ্ণুতার জগত. 
আর কত মৃত্যু দেখব আমরা? ভয় লাগে. কষ্ট হয়. আবার একই সঙ্গে মনে হয় এই তো প্রকৃতির নিয়ম. সুধু একটা আফসোস লাগে সুনীলদা. আপনি যদি শুধু কবিতা লিখতেন, তাহলে হয়ত কিছু ক্লাসিক উপন্যাস আমরা পেতাম না. কিন্তু আমি নিশ্চিত, আমরা পেতাম আরও বেশি অসামান্য কবিতা. ব্যাক্তিগত ভাবে  কবি সুনীল গাঙ্গুলী আমার কাছে অনেক বেশি বন্ধু. তাঁর সঙ্গে কথা বলা যায় অনেক.
তাঁর কবিতার সঙ্গে কথা বলা যায় অনেক.
তাঁর কবিতার মধ্যে মুখ ডুবিয়ে বসে থাকতে ইচ্ছে করে. এই প্রেম, এই কবিতা, এই আবেগ এবং অনুভূতিজগতের বিস্ফোরণ আমি অন্য কোথাও খুব কম পাই. 
তাঁর মধ্যে যে হারিয়ে যাওয়ার কিশোর ছিল, সে আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে রয়েছে. আসলে সেই নীল লোহিত-ইতো আমাদের কবি. আমাদের সেই কবি যে দিকশুন্যপুরে হারিয়ে যেতে চায়. তার কি মৃত্যু হতে পারে? আর কে না জানে, এবারই কবি সুনীল গাঙ্গুলী জীবিত হয়ে উঠবেন আমাদের কাছে. সময়ের কাছে. 
ভাস্করদা লিখেছিলেন- চলে যেতে হয় বলে চলে যাচ্ছি, নাহলে তো আরেকটু থাকতাম.
কবি হলেন এক প্রদীপের মত. যে নিজে শুন্য হতে হতে আলো দিয়ে যায়. আর সেই আলো মরে না কখনো. সময়ের কাছে চিরকাল সে ঘুরতে থাকে. আলোকেবর্ষ পেরিয়ে যায় তার সেই আলো. কবির মৃত্যু হয় নাকি আদৌ?
(ক্রমশ) 

Comments