এলোমেলো আমি-২৪


এলোমেলো আমি-২৪

আবার হেমন্তকাল. শীত আসছে. অদ্বুত একটা আলো দেখা যায় মাঝেমাঝে এ সময়ে বিকেলবেলাতে. সেই আলো খুব মন কেমন করা আলো. মা-বোন বেড়াতে গেছে. বাড়িতে একা কয়েকদিন জ্বর এর সঙ্গে যুঝলাম আর দুপুর গড়িয়ে বিকেল, বিকেল গড়িয়ে সন্ধে নামল. দেখলাম. মাঝেমাঝে জানলা থেকে মুখটা বার করে দেখার চেষ্টা করলাম নীল আকাশ. সাদা সাদা মেঘ. মনে পড়ে গেল শরত তো বিদায় নিয়েছে. এসে গেছে হেমন্ত. আর কয়েকদিন পরেই শীত আসবে. এই সময় আলো যখন ঝুপ করে নিভে যায়, তখন খুব মন খারাপ হয়. এর আগে আমি যখন কিছুই করতাম না, তখন মাঝেমাঝে গঙ্গার ধরে গিয়ে বসে দেখতাম হেমন্তের বিকেল. পা ডুবিয়ে রাখতাম জলে. আমার পায়ের পাতায় কে যেন ডাক পাঠাত. কে যে সে! এই সময়ে পুরনো বাড়ির রং আর দেয়াল গুলি থেকে বেরোনো গাছগুলির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে খুব বুড়ো হয়ে যাই বলে মনে হয়. এই মনে হওয়া এখনকার না. সেই কোন কৈশোর থেকে এই মনে হওয়া. কৈশোর থেকেই আমার এই সময়ে কেমন যেন জ্বর জ্বর ভাব আসে. যদিও অনেক সময়েই এবারের মত জ্বরে আক্রান্ত হই না. পাহাড়ে আবার এই সময়টা দারুন. পাহাড়ে গেলে এই সময়ে মন খারাপ হয় না. আমি একবার চোপ্তার পাহাড়ি ঢালে দেখেছিলাম কীভাবে সূর্য আস্ত যাচ্ছে. ওহ! সে অসংখ্য সূর্য! অসংখ্য মৃত সূর্য. একটি একটি করে উপত্যকা পেরিয়ে সে নামছে আর তার লাল কমলালেবুর মত শরীরে দেখতে পাচ্ছি পাহাড়ের ছায়া. কোন সে পাহাড় কে জানে! এ সময়ে পাহাড়ের একটা অন্য সৌন্দর্য আছে. উপরে বরফ পড়া শুরু হয়ে যায়. পাহাড়ের মাথাগুলো বরফে ঢাকা থাকে. আর একটা সুন্দর হাওয়া বইতে থাকে চারিদিকে. সেখানে কেন যে মন খারাপ হয় না জানি না. কিন্তু এই হেমন্তকাল আমার কবিতা লেখার প্রিয় সময়. আমার জীবনের অধিকাংশ কবিতা আমি লিখেছি এই সময়ে. এই সময়ে কলকাতা আর মফস্বলের রাস্তাঘাটের চেহারায় বদলে যায়. একটা অসামান্য গন্ধ বইতে থাকে চারিদিকে. সেই গন্ধের ভিতরে থাকে অনেকটা মৃত্যুর মত স্নেহ. আমার মনে পড়ে সকলকে. জীবনানন্দ দাশ যেমন লিখেছিলেন কোনো কোনো অঘ্রানের অন্ধকারে হেঁটে যাওয়া শান্ত মানুষের / হৃদয়ের পথে ছাড়া মৃতের কোথাও নেই মনে হয়. আচ্ছা মৃতের সত্যি কোথাও নেই? লীন হয়ে গেলে তারা সত্যি লীন হয়ে যায়? যেহেতু নাস্তিক আমি, তাই অন্য কিছু কল্পনাও করি না. তবে কাল শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম যে এই নাস্তিকতাও একটা ধর্মের মত. নাস্তিকতাও এক ধরনের আস্তিকতা. ধর্ম যেমন জীবন, চেতনা, বিশ্বাসের মধ্যে এক ধরনের অনুশাসন তৈরী করে তেমন নাস্তিকতাও করে. নাস্তিকতা কল্পনা করতে দেয় না. এর মানে এ নয় যে আমাকে পরম ভক্ত হতে হবে. আবার এর মানে এও নয় আমার কল্পনার উপর নিষেধাজ্ঞা চাপাতে হবে. আমি তো স্বপ্নকে  নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না. মানে আমি আমার অবচেতন কেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনা. তাহলে আমার সচেতন অস্তিত্বে ভাবনার ভিতরে নিষেধাজ্ঞা চাপাব কেন? আমি কি আসলে কিছুই জানি? জানি না তো. 
এই যে অকারণে মনটা খারাপ হয়ে আছে আমার তার কারণ কি? সেই কারণটা কি খোঁজার খুব একটা দরকার আছে? এই যে মন খারাপ লাগছে আর আমি এক নিমেষে রোদ্দুরের দিকে চেয়ে ছিলাম. সকাল্বেলাতে কী উজ্জল লাগছে চারিদিক! আমার ত্বক খুব শুকিয়ে গেছে. কিছু লাইন মাথার ভিতরে মনের ভিতরে গুনগুন করে উঠলো. আমি খাতাটা তুলে নিয়ে লিখতে শুরু করলাম. লিখলাম. লেখাটা হলো কি হলো না জানি না. হয়ত হলো. আগের মত তো আর জানার ইচ্ছে করে না কে কি বলল. শুধু এক চরম উত্তেজনা কাজ করে লেখার পরেই. মনে হয় বেঁচে থাকাটা সার্থক হলো. কিছু কথা বলতে পারলাম. আরো কিছু কথা.
আমার একটা সমস্যা আছে. আমার সঙ্গে যারা মৌখিক কথা বলে তাদের সঙ্গে আমি যে কী বলি.. তারা যথারীতি ভুল বোঝে. আমি কিন্তু তাদের কোনো ক্ষতি করতে চাইনা. অপমান করতে না, দু:খ দিতে না. আমি শুধু এটুকু বুঝতে পারি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমি কথাটা ঠিক বলতে পারি না. কাজের জগতে কথা বলার একটা বিশেষ ধরন আছে, বিষয় আছে. ফলে আমার অসুবিধা হয় না. কিন্তু যখনি মনের কথা বলতে গেছি, তখনি আমি ব্যর্থ. এর কারণ হিসেবে আমি দেখেছি আমি সবসময়ই আমার মনের সঙ্গে কথা বলতে বিশেষ সাচ্ছন্দ বোধ করি. এবং আমি যদি কোথাও আমার কথা বলতে পারি তবে তা আমার লেখায়. কী আশ্চর্য আমি মানুষের মত না তাহলে! এ কারণে অনেকের সঙ্গেই আমার ভুল বোঝাবুঝি হয়. হয়ত আমার এই ধারাবাহিক ভাবে একা থাকাই এর কারণ. 
তাহলে কি আমার ভিড়ের মধ্যে মিশে যাওয়া উচিত? উচিত কেন তবু এমন একাকী না বলে একা থাকার গল্পটাকেই জীবন থেকে দূর করে দেওয়া?
আমার এক বন্ধু বলেছেন এই এলোমেলো আমি লেখা আমার বন্ধ করে দেওয়া উচিত, এতে নাকি আমার ক্ষতি হতে পারে. তা হোক গে যাক. কী আর ক্ষতি হবে! আমি তো কোনো সময়েই মেপে মেপে কোনো কাজ করিনি. এখনো করছি না. আমার মনে যা আসছে আমি লিখে রাখছি. 
যাই হোক. 
অনেক মদ খেলে যেরকম মাথাটা থাকে আমার মাথাটা তেমন এখন. কী একটা ঘোরের মধ্যে রয়েছি. এই ঘোর আমার পরিচিত অনেকেই ঠিক পছন্দ করতে পারেন না. তাতে আমার কিছু করার নেই. এই যে আমি এখন কোথাও যাই না. শুধু নিজের মধ্যে থাকি.. মাঝেমাঝে শুধু মনে হয় দুরে কোথাও বেরিয়ে পড়ি. তাও একা একা. আসলে একা ঘোরার মধ্যে একটা সুন্দর ব্যাপার আছে. যে জায়গায় যাই, সেখানকার সঙ্গে আমার আত্মা কথা বলে. সেখানকার রাস্তার বাঁক, গাছ, মানুষের মুখ, বিমর্ষ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বাড়ি, তার ভিতর থেকে ঠিকরে আসা মানুষের গল্প, টুকরো টাকরা কথাবার্তা, আলোর আভাষ, অন্ধকার- আলোর লুকোচুরি, গন্ধ, - সব কিছুর সঙ্গে আমার একটা সম্পর্ক তৈরী হয়. এই সম্পর্কটা আমাকে ঋদ্ধ করে.
গতকাল অনেকদিন পর অলোকদার সঙ্গে কথা হলো. কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত.
কিন্তু যার টেলিফোন আসার কথা তার টেলিফোন আসেনি.
হয়ত আসবেও না কখনো. আমার মনের মধ্যে এখন একটা সোঁদা মাটির রাস্তা ছুটে চলেছে. 
তুমি কি আসছো? 
(ক্রমশ) 

Comments

  1. আমার মনে হয় নাস্তিকতাও এক ধরনের বিশ্বাস। আর নাস্তিকতা থেকেও মৌল্বাদীতার সৃষ্টি হতে পারে। নাস্তিকতা মানুষকে খুব বেশী কল্পনা করতে দেয় না। হেমন্তের বিকেল আমারও খুব প্রিয়। তবে আমার বিশ্বাস যাত প্রতীক্ষায় আছেন সে আসবে। নিশ্চই আসবে।

    ReplyDelete

Post a Comment