এলোমেলো আমি-১২


এলোমেলো আমি-১২ 

সাহিত্য আকাদেমির কবিতা চর্যা অনুষ্ঠানে আমার প্রথম কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তর সঙ্গে আলাপ. আমার মনে আছে আমার শিকার কবিতাটির খুব প্রশংসা করেছিলেন. কবিতা নিয়ে নানা আলোচনা-ও হয়েছিল. আমার পান্ডুলিপি তাঁকে দিয়েছিলাম. তুমি, অরক্ষিত-এর পান্ডুলিপি পড়ে উনি আমাকে পরে ফোন-ও করেছিলেন. কিন্তু তার পর আবার অনেক দিন আমাদের যোগাযোগ ছিল না. ছোটবেলা থেকে অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত-এর নানা কবিতা আমার প্রেরণায় বলা যায়. যৌবন বাউল, নিষিদ্ধ কোজাগরী ছাড়াও তাঁর অনবদ্য গদ্যভন্গিমা আমাকে মুগ্ধ করে রাখে. কিন্তু ব্যাক্তি অলোকরঞ্জন এর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা হয় অনেক পরে. সে সময়ে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলন চলছে পুরোদমে. বিজল্প থেকে অলোকরঞ্জন এর কবিতার বই গোলাপ এখন রাজনৈতিক প্রাক্ষের প্রাক্কালে আমার সঙ্গে অলোকরঞ্জন-এর আলাপ জমে ওঠে. আমি আমার তারামনির হার, আবার হেমন্তকাল, এবং সেই সময়ে প্রকাশিত ১৪.৩.২০০৭ তাঁকে দি. এবং তাঁর সঙ্গে কবিতার আলোচনা ছাড়াও জমে ওঠে নানা বিষয়. আমি তাঁকে বলি যে ভাবে এই আন্দোলন এগোচ্ছে তাতে সিপিএম সরকার হয়ত যাবে, কিন্তু যে সরকার আসবে, তাও ফ্যাসিবাদী ভূমিকায় নিয়ে আসবে. ক্রমে ক্রমে আমি সকলের থেকে বিছিন্ন হতে শুরু করি বিভিন্ন মানুষের রাজনৈতিক নিরভিসন্ধিতে. 
কিন্তু কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত-এর সঙ্গে আমার সম্পর্ক অটুট থেকে যায়. এরই মাঝে আমি জার্মান ভাষাটাও শিখতে শুরু করি. সে নিয়েও অলক্রন্জনের সঙ্গে আমার কথাবার্তা হত. উনি জার্মানি থেকে আমাকে প্রায়শই ফোন করতেন. আমিও ফোন করতাম আমার ইচ্ছে হলেই. নানা বিষয়ে, আমার সঙ্গে তাঁর কথাবার্তা হত. প্রচুর চিঠি পাঠিয়েছি তাঁকে. 
উনিও আমাকে কম চিঠি পাঠান নি!
অলোকরঞ্জন কীরকম মানুষ তা এক কথায় বলে বোঝানো সম্ভব না. এক কথায় বলতে গেলে অলোকরঞ্জন তেমনি একজন মানুষ যিনি আমাকে বাঁচার নতুন নতুন প্রেরণা দিয়ে গেছেন. মনে পড়ে চন্দনদা কে. চন্দনদা মারা গেলেন. চন্দনদা অলোকদার ভাই. অলোকদার উপর এখনো নির্ভর করে থাকেন এখানকার অনেকে. অর্থনৈতিক কারনেও. আর উনি এখানে এলে তো নানা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বা নানা সাহিত্য-পত্রিকা থেকে নানা কর্মকান্ডে তাঁকে জড়িয়ে ফেলাই হয়. অলোকদা কাউকে কোনো বিষয়ে না বলতে পারেন না. যে বিষয়টি অলোকদার বৈশিষ্ট তা হলো উনি সম্পূর্ণত কবি একজন. এই আরেকজন মানুষ যিনি আত্মবিস্বাস্ত, অগাধ পান্ডিত্য এবং কাউকে তোয়াক্কা করেন না. একবার মনে আছে জয়দা আর আমি গেছিলাম অলোকদার বাড়ি. উনি একটি ছোট পুস্তিকা থেকে মধ্যযুগের  পোলিশ মরমিয়া কবিতা শুনিয়েছিলেন. সেই সব কবিতার খোঁজ আমরা রাখিনা. আমি তাঁকে অনুরোধ করেছিলাম এই পোলিশ মরমিয়া কবিতা-এর অনুবাদ করতে. জানি না উনি কবে করবেন.
তাঁর স্ত্রী ত্রুতবার্তা দাশগুপ্তর মৃত্যুর পর এবং তাঁর মায়ের মৃত্যুর পর অলোকদা ভিতরে ভিতরে খুব একা হয়ে গেছেন. প্রভাব পড়েছে তাঁর শরীরে. এক বিচিত্র অসুখ আছে তাঁর এখন. সেই অসুখের চিকিত্সাও সম্ভব বিদেশেই. এক বার দেখিয়েছিলেন আমাকে তিনি. পায়ের গোড়ার দিকটা কালো হয়ে আছে. অথচ ওই শরীর খারাপ নিয়েও উনি যখন এখানে আসেন, তখন বিশ্রামের সুযোগ পান না. 
আমি যখন খুব ভেঙ্গে পড়ে আছি, তখন উনি আমাকে বারবার ফোন করে প্রাণিত করেন.
আমার খবর এমন একজন বড় কবি নেন, এটা আমার কাছে একটা পুরস্কার অবশ্যই.
জগতগৌরী কাব্যের সমালোচনা যখন উনি করেন, আমি জানতাম না. বেরোনোর পর আমি কেঁদে ফেলেছিলাম. কারণ সেই সময়ে আমি সব জায়গা থেকেই নির্বাসিত. 
সেই নির্বাসন এখনো চলছে.
উনি আমাকে বলেছিলেন তুমি গদ্য লেখ. তুমি অন্যরকম. তোমাকে লিখতে হবেই. 
কিন্তু কোথায় লিখব অলোকদা?
কে আমার লেখা সাদরে প্রকাশ করবে? সবাই তো কোনো না কোনো পক্ষ নিয়ে আছেন. 
আর আমার তো কোনো পক্ষ নেই.
উনি আমাকে বলেছিলেন এই একা থাকাটাই তোমার শক্তি. 
আজ হঠাত লিখতে লিখতে তাঁর কথা মনে পড়ছে. এই সঙ্গে মনে পড়ছে আমি একদিন জানতে পারি বিনয় মজুমদার আমার সম্পর্কে খুব প্রশংসা করেছেন. শুনে আমি স্তম্ভিত হয়ে যাই. সেই কবে তাঁকে আমার তুমি, অরক্ষিত আর আবার হেমন্তকাল পাঠিয়েছিলাম. তিনি পড়েছেন এবং গ্রন্থী পত্রিকার একটি সাক্ষাত্কারে আমার সম্পর্কে উচ্ছসিত প্রশংসা করেছেন. এটাও ছিল আমার কাছে এক পুরস্কার. 
আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি বিনয় মজুমদার এবং অলোকদার মত কবি আমাকে নিয়ে উচ্ছসিত.
কিন্তু সত্যি বলতে কি আমি নিজে কাউকে গুরু বলে মনে করি না.
অলোকদার সুরদাসের ধুন গুলি অনুবাদ করা একটি বই আমার কাছে এসেছিল.
একটি বিশেষ প্রকাশনা চাইছিল সেই বইটি সটিক প্রকাশ করতে.
অলোকদা আমার উপরেই দায়িত্ব দিয়েছিলেন সেই বইয়ের সটিক প্রকাশনার.
কিন্তু আমার প্রচুর পরিশ্রম করে সেই পান্ডুলিপি তৈরী করার পরেও বইটি আজ প্রকাশ পায় নি.
এই খেদ আমার যাবে না.
জার্মান কবিতা আমি যা অনুবাদ করেছি, তা অলোকদার সাহচর্য ছাড়া হত না.
হঠাত খুব মন খারাপ লাগছে অলোকদার জন্য.
কতদিন কথা হয়নি!
এই একটু আগে একটা ফোন এলো রাজীব সিংহর কাছ থেকে যে তাঁরা তাঁদের পত্রিকায় এলোমেলো আমি-এর কিছু পর্যায় প্রকাশ করতে চান.
এই অংশ-ও যদি প্রকাশ করেন তা হলে ভালই হবে.
আমি ভাবতে পারিনি কেউ এই লেখাগুলো পড়বে. কারণ লেখাগুলো তো কেবল নিজের সঙ্গে কথোপকথন. 
নিজের মনের শান্তির জন্য!
আর আমি তো লিখেই যাব.
এটাই তো আমার কাজ. আমার সত্তা. 
তার কাছে যে ফিরতে চাইছি আমি!
(ক্রমশ)

Comments

  1. এলোমেলো আমি প্রকাশ পাবে শুনে ভাল লাগল। আপনাকে কিন্তু আরো লিখতে হলে হিন্দোল দা। আপনি যে অন্যরকম মানুষ। অন্য ভুবনের মানুষ।

    ReplyDelete
  2. ভালো লাগল পড়ে । কিন্তু কেমন যেন হেরো-হেরো ভাপ উঠছে মনে হল পড়ে । লিখতে থাকো । ভালো থেকো।
    মলয়দা

    ReplyDelete
  3. Malayda,heyro heyro bhap aar nischesto howata ek noy mone hoy.

    ReplyDelete
  4. Hindol Da, Elomelo ami prokash hobe sune bhalo laglo.

    ReplyDelete
  5. This comment has been removed by the author.

    ReplyDelete
  6. Amar ei khane protidin amar sokal hochchhe tomar lekha pore. Ei je tumi sob kichhu theke aste aste bijukto hoye gachho, er ekta bhalo dik achhe eta bhebe bhalo lagchhe.

    ReplyDelete

Post a Comment