চাঁদের পাহাড় দেখে স্বয়ং লেখক লিখলেন পরিচালককে ( চিঠিটি ফাঁস হয়েছে কাল রাতে)
চাঁদের পাহাড় দেখে স্বয়ং লেখক লিখলেন পরিচালককে ( চিঠিটি ফাঁস হয়েছে কাল রাতে)
শ্রী কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়,
এই শীতে আমার আসার কথা ছিল না। বেশ ছিলাম গন্ধর্বলোকে। গত তিন বছর আমি পশ্চিমবঙ্গেই আসিনি। ঘাটশিলা ঘুরে চলে যেতাম। এবার হলো কি, আমার এক তরুণ বন্ধু আমাকে ই-মেল-এ জানালো বঙ্গে নাকি আমার প্রয়োজন পড়েছে। শুনে বেশ অবাক হয়েছিলাম। কারণ দীর্ঘদিন হলো পশ্চিমবঙ্গে আসি না। শুনতে পাই আমার উপন্যাস নাকি এখন প্রচুর লোকে পড়ে। শুনে বেশ ভালো লাগে। মানিক বলে একজনের সঙ্গে দেখা হয়েছিল স্বর্গে। শুনেছিলাম তার মুখে, যে সে আমার অনেকগুলো উপন্যাস নিয়ে ছবি করেছে। আর সেগুলো নাকি সারা বিশ্বের মানুষদের বেশ মনে ধরেছে। উপন্যাস লিখলেও আসলে আমার উপন্যাসগুলো যে ছদ্মবেশী কবিতা, সেগুলোর আবার ফিল্ম হয় নাকি? মানিক আমাকে বুঝিয়েছিল নানা কিছু। জানতে পেরেছিলাম অনেক কিছু। যবে থেকে জানলাম, ব্যাস আমার স্বর্গে নিরাপদ ঘুরে বেড়ানো মাথায় উঠলো। এই সিনেমা মাধ্যমে যে এত কিছু কাজ করা যায়, যদি আগে জানতাম! অনেকটা কবিতার কাছাকাছি। ইসস যদি আমার একখানা ক্যামেরা থাকত! কত কথা যে ক্যামেরাতে ধরে রাখতে পারতাম! হয়ত অনেক কিছু লিখতাম-ই না! তার পর-ই মনে হত, আমি তো দৃশ্য লিখিনি। দৃশ্যের ভিতরে থাকা ইতিহাসবোধকে লিখে রেখেছি। সৌন্দর্যবোধ লিখে রেখেছি। সবচেয়ে বড় কথা অনুভূতিমালা লিখে রেখেছি। এই অনুভূতিমালা কী শুধু দৃশ্যের মাধ্যমে প্রকাশ সম্ভব?
তো এবারের শীতে এলাম কলকাতায়। এসেই একটা দীর্ঘ রাস্তা দিয়ে যখন আমাদের গাড়ি ছুটছে, সে সময়ে রাস্তার পাশে দেয়ালে দেখলাম পোস্টার। তাও আবার চাঁদের পাহাড়-এর। মনটা আনন্দে নেচে উঠলো। আমার উপন্যাস এখনো লোকে পড়ছে। শুধু পড়ছে তাই নয়, এমন ভাবে বিজ্ঞাপন-ও করছে! আমার বন্ধু আমার কথা শুনে ব্যাপক হাসলো আর বলল এ জন্যই তোমাকে এত করে ডাকা। পরে খোলসা করতে বুঝলাম চাঁদের পাহাড় সিনেমা হয়েছে। আরো অনেক গল্পও শুনলাম। আফ্রিকায় শুটিং, ১৫ কোটি টাকা খরচ, নায়ক দেব ( প্রথমে ঘাবড়ে গেছিলাম। দেবযান পড়ে কি এই নাম? তাহলে তো....তার পরে শুনলাম না, তিনি অত্যন্ত জনপ্রিয় একজন নায়ক। ) .... আরো কত কী! নির্ধারিত সময়ে যখন একটা ঝাঁ চকচকে সিনেমা হল-এ পৌছলাম, দেখলাম সেখানে খুব ভিড়। টিকিট পাওয়া যাচ্ছে না। আমার বন্ধুটি কথা থেকে টিকিট সংগ্রহ করলো জানি না।
সিনেমা শুরু হলো। শব্দে কান ফাটে প্রায়। জীবনে এত শব্দের মধ্যে থাকি নি। কিন্তু চোখ জুড়িয়ে গেল। ওই তো আমার বইয়ের পাতায় পড়া আফ্রিকা। আশপাশ থেকে উশখুশ শব্দ শুনে দিলাম ধমক। আফ্রিকা দেখাচ্ছে , দেখে নে রে- আমার বন্ধুটি বলল ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক, এবং আরো কিছু চ্যানেলের নাম, যেখানে নাকি রিমোট ঘোরালেই আফ্রিকা। তার পর নাকি ইন্টারনেট নামক একটা বস্তু আছে, চাইলেই দেশ ভ্রমণ। হাতের মুঠোয় নাকি এখন ভূগোল। কে জানে, এই সময়ে থাকলে হয়ত আমি চাঁদের পাহাড় উপন্যাসটাই লিখতাম না। আরও বিবরণ দরকার ছিল জায়গাটার। সে সব তো দেওয়া হয় নি। কি করেই বা দেব, আমি তো আফ্রিকা আসিনি কখনো।
শুনলাম আপনি সিনেমাটার পরিচালক। আপনি এসব জায়গায় গেছেন।..শুনেই মন নত হয়ে আসে। আর আমার উপন্যাসের সিনেমার জন্য গেছেন, এতে মন আরও ভরে যায়।
কিন্তু ভাই, এসব কী দেখলাম !
মন বড় ক্লান্ত হয়ে এলো। তাহলে কী আমার উপন্যাসগুলির বহিরঙ্গ দিয়েই মানুষ মাতাল হলো? আমার উপন্যাসগুলো কী এত দুর্বোধ্য যে বোঝা যায় না? চাঁদের পাহাড় তো অত্যন্ত সহজ ভাষায় লেখা। আমাকে কী তাহলে কেউ বুঝলো না? এই শংকর ? আমি তো তাকে এক আদ্যন্ত বাঙালি চরিত্র হিসেবে গড়ে তুলেছি। সে ভয় পায়, কিন্তু স্বপ্ন দেখে। সে মনে মনে গুটিয়ে যায় কিন্তু আত্মসম্মান তার অটুট। সে আরব বেদুয়িন নয়, কিন্তু চোখে তার অজানাকে জানা অচেনাকে চেনার বিস্ময়বোধ সর্বদা। শুধু এই বিস্ময়বোধ সম্বল করেই শংকর -এর মত অজস্র ছেলে মেয়ে কখনো স্বাধীনতা যুদ্ধ, কখনো দিনবদলের যুদ্ধে নেমে পড়ে। বিপদকে বিপদ জ্ঞান করে না। এ জন্যই সে কবিতা লিখতে পারে। এ জন্যই পাহাড়ে বেড়াতে যেতে পারে। আর এ জন্যই আমার চাঁদের পাহাড় এখনো মানুষের বড় হয়ে ওঠার সঙ্গী। আমি তো তাকে প্রতিশোধ নিতে শেখাইনি। সে নিজেকে বাঁচাতে চেয়েছে। সে ভালোবেসেছে সাহসকে। ভালোবেসেছে রোমাঞ্চ। তাই কখনই সে রক্তে স্নান করে সিংহ মারতে পারবে না। বা ফাঁদ তৈরী করে বুনিপকে মারতে পারবে না। এ কী করলেন? আমার মূল চরিত্রের মধ্যে যে আমি আছি। আমাকেই বুঝতে পারলেন না? আমার সারাজীবনের লেখার মধ্যে যে অন্য়েষণ , তাই তো চাঁদের পাহাড়ে শঙ্করের মধ্যে আছে, অজানাকে জানার আগ্রহ, অচেনাকে চেনার আকাঙ্খা। সে কিন্তু ডন জুয়ান নয়।
চাঁদের পাহাড়-এ আসলে আপনি শংকরকে হিরো বানিয়েছেন। ওখানেই তো ভুল, ভাগ্যিস আমাকে সিনেমা বানাতে হয়নি। কারণ চাঁদের পাহাড়-এ নায়ক হলো জার্নিটাই। বহিরঙ্গ ছেড়ে যদি একটু অন্তরঙ্গ হতেন, তাহলে ভালো হত!
আপনি তো আফ্রিকা গেছেন। তাহলে এই ভুল করলেন কী ভাবে? কোথায় ভিক্টোরিয়া ফলস আর কোথায় ভিক্টোরিয়া লেক? লেকটা উত্তর পূর্বে আর তার অনেক দক্ষিণে, প্রায় দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে ভিক্টোরিয়া ফলস। সম্ভব কখনো ভিক্টোরিয়া লেক ধরে ভিক্টোরিয়া ফলস-এর কাছে যাওয়া? আফ্রিকা মহাদেশটা কত বড় বলুন তো?
অন্যান্য বিষয় বাদ দিলাম, কিন্তু আপনি বুনিপকে দেখিয়ে দিলেন? বুনিপের বুনিপত্ব আছে বলেই চাঁদের পাহাড়-এর রহস্য আছে। শংকর-এর মত প্রথম এক্সপিডিশনে যাওয়া একটি ছেলে যদি ফাঁদ তৈরী করে বুনিপকে মারতে পারে, তবে আলভারেজ বা ওই এলাকার আদিম অধিবাসীরা পারল না? শংকর কী তাদের চেয়েও সাহসী? অভিজ্ঞ? হিসেবেও মেলে না, অনুভূতিতেও না।
আসল কথা কমলেশ্বরবাবু, আপনি আমার ভাবনা এবং আমার লেখা চরিত্র কিছুই ধরতে পারেন নি। এটা যদি আমার চাঁদের পাহাড় নাও হত, তাহলেও ভীষণ গাঁজাখুড়ির গল্প হত। যার সঙ্গে আমার চাঁদের পাহাড়- বাঙালির চাঁদের পাহাড়-এর মূল এসেন্স যে রোমাঞ্চ, ভালবাসা, দুচোখে বিস্ময়বোধের যে ইউটোপিয়া , তার কোনো সম্পর্ক নেই।
সিনেমার শেষে কথা বলার মত পরিস্থিতিতে ছিলাম না। এত লোক চাঁদের পাহাড় দেখছে। এত লোক কী আমার উপন্যাসটা পড়েছে? যারা পড়েনি, তারা কী জানলো?
পুনশ্চ : কখনো দেবযান করবেন না দয়া করে। কারণ আপনি করলে সেটা তো একটা ভুতের সিনেমা হয়ে যাবে!
ইতি
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
vari sotti katha likhe diyechen..
ReplyDeleteঅনেক.................... সুন্দর। অনেক..........! অনেক.....! অনেক..! ভাল লাগল । এই রকম অসাধারন একটা পোস্ট দেয়ার জন্য ধন্যবাদ। আসা করি এই রকম পোস্ট আরও পাব। সময় থাকলে আমার desh online store সাইটে ঘুরে আস্তে পারেন।
ReplyDelete