এলোমেলো আমি-১৫


এলোমেলো আমি-১৫ 


গতকাল একটি অদ্ভুত স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙ্গে গেল. দেখলাম গার্গী খুব কাঁদছে আর আমি কিছুতেই তাকে শান্ত করতে পারছি না. আমি তার সামনে আছি এটাই গার্গী বুঝতে পারছে না. ঘুম ভেঙ্গে গেল. আমি এমন সব স্বপ্ন দেখি যেগুলো পরে আমার নিজের কাছেই অদ্ভুত লাগে. কেন দেখলাম? মন কি কোনো বার্তা পৌছতে চাইছে আমার কাছে? যেমন পরশু রাতে আমি প্রায় অনেক সময় ধরে এমন একটি স্বপ্ন দেখেছি যে আমি নিজেই আশ্চর্য হয়ে গেছি. আমার খুব ইচ্ছে করে সেই সব স্বপ্নগুলো লিখে রাখতে. আমার বিছানায় একটা খেরোর খাতা আছে. আমার সদ্য লেখা কবিতা আমার স্বপ্নগুলো সেই সব খাতায় লেখা থাকে. তেমনি একটি স্বপ্নের কথা বলি. আমি দেখলাম আমি চেয়ার থেকে উঠতে পারছি না. আমার সামনের টেবিলে এক গ্লাস রঙিন জল. আমি স্বপ্নের মধ্যেই গন্ধ পাচ্ছিলাম. আমার প্রিয় হুইস্কি আর সি. আর পাশে প্রচুর ঘুমের অসুধ. আমি দেখলাম একলা একটা হাওয়াময় ঘরে আমি বসে আছি. আমার হাতটা কুঞ্চিত. আমার চারপাশে কেউ নেই. হাতটা কাপছে. আমি উঠে দাঁড়ালাম. আয়নার সামনে গেলাম আর দেখলাম আমি বেশ বয়স্ক হয়ে গেছি. আমাকে দেখতে একদম পাল্টে গেছে. আমি সেই ওষুধ গুলো এক সঙ্গে ঢাললাম সেই গ্লাস-এ. তার পর আমি বসে পরলাম আমার চেয়ারে. এমন সময়ে কলিং বেল. কোনক্রমে আমি উঠে দরজা খুলতেই দেখি আমি স্বয়ং. আমার দিকে তাকিয়ে সে বেজায় তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো. আমি বললাম-এস. সে ঢুকলো. বলল- আমাকে চিনতে পারছ কি? আমি ছিলাম তোমার ২৫ বছরের তুমি. মনে পড়ছে কিছু? সে আমার দিকে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ. আমি তার কাছে ক্ষমা চাইলাম. আমাকে বলল - ক্ষমা চাইছ আমার জীবনটাকে নষ্ট করে দিয়ে? তোমার কোন অধিকার আছে ক্ষমা চাওয়ার? সেই সময়ে আমার আয়না থেকে বেরিয়ে এলো এই সময়ের আমি. তার হাতে একটি খোলা ভোজালি. আমাকে বলল তুমি আত্মহত্যা করতে চাইছ কোন আক্কেলে? তোমাকে তো হত্যা করা উচিত. মনে পরে সেই সব দিনগুলো যখন তুমি ক্রমাগত ঠকিয়ে গেছ তোমাকে যে সব থেকে বেশি ভালবাসত তাকে. সে কত কষ্ট পেতে পারে তা নিয়ে তোমার কোনো মাথাব্যথা ছিল না. তোমাকে হত্যা করা উচিত. তোমার আত্মহত্যার অধিকার নেই. সেই সময়ে পিছনে টুক করে আওয়াজ শুনে তাকালাম. দেখলাম আমি আরেকটু বড়. আমার মুখ চোখ একদম কালো হয়ে গেছে. সে আমাকে বলছে- নিজেই নিজের কবর খুঁড়ে এখন পালাতে চাইছ? আমাকে হত্যা করেছ তুমি-ই.  আমি লিখতাম. আমার সব লেখা তুমি ছিঁড়ে ফেলেছ. লেখাকে আসতে দাও নি. তুমি আমাকে হত্যা করেছিলে. তুমি তোমার সন্তান এর হত্যার জন্য দায়ী. তুমি তোমার সত্তার হত্যার জন্য দায়ী. এখন নিজে পালাতে পারবে   না. তোমাকে আমরা এভাবে মরতে দেব না. তোমাকে আমরা মারব. আমি দেখলাম আমার দিকে সবাই এগিয়ে আসছে. সবাই আমি. আর আমি ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে হাতে তুলে নিছি গ্লাস. আমি গিলে নিতে চাইছি আমার বিষ. কিন্তু পারছি না. খুব যন্ত্রণার মধ্যে আমাকে কে যেন আঁকড়ে ধরেছে. আর তখনি আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল. 
এমন স্বপ্ন যে আমি মনে রেখে দিয়েছি. ভুলতে চেয়েও ভুলতে পারিনি. জীবনে যা কিছু ঘটে সবই কি শুধু পর্যায়ক্রমে ঘটে যাওয়া বাস্তবিক ঘটনার কোলাজ? না কি আমাদের স্বপ্নের মধ্যেও এমন কিছু ঘটনা ঘটে চলেছে যেগুলির সঙ্গে আমাদের বাস্তব জীবনের ক্ষীন হলেও কোনো না কোনো যোগসূত্র আছে. হয়ত স্বপ্নের মধ্যে এমন আরেক জার্নি আছে যা সরলরৈখিক সময় দিয়ে ধরা যায় না. না হলে কী ভাবে কেউ তাঁদের মৃত্যু দৃশ্য দেখেন আগে থেকেই? কী ভাবে কোনো এক অপরিচিত জায়গায় গেলে মনে হয় এমন জায়গায় আমি আগেও এসেছি? এমন কী ওই বাঁকটা ঘুরলে কী দেখতে পাব, তার একটা হদিস পাওয়া যায়. লোকজনকে এমন সব বলে আমি চমকেও দিয়েছি. কারণ অনেক জায়গায় গিয়ে আমার মনে হয়েছে আমার এই জায়গা খুব চেনা. আমি এই জায়গার খুঁটিনাটি চিনি. এবং দেখা গেছে চিনিও. সত্যি চিনি. আবার এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে  যেগুলির সময় মনে হয়েছে এই ঘটনাটি আমার জীবনে আগেও ঘটেছে. সেই সময় চারিদিক খুব পাল্টে যাচ্ছে বলে মনে হয় আমার. এটা ঠিক এমন যে সব সময় হয় তা নয়. কিন্তু হয়. 
অর্থাত বাস্তব জীবনে ঘটে যাওয়া ন্যারেটিভ-ই আসল ন্যারেটিভ নয়. জীবনটাও কি একটা গল্প? একটা উপন্যাস? যার কোনো কোনো পরিচ্ছেদ আগে অন্য কথাও লেখা হয়, তার পর জীবন আবার তার কাছে ফিরে আসে? আমি ভেবে দেখেছি রিয়ালিজম বলতে যা আমরা বুঝি তা আসলে নিজেই একটা ভ্রম. রিয়ালিজম এর ভূত আমাদের ঘাড়ের উপর চেপে বসে থাকে. সেখান থেকে আমরা বেরোতে পারি না. লেখার সময়েও তাই ন্যারেটিভ থেকে না বেরোনো লেখা যদি পড়তে হয় তাহলে আমরা মুশকিলে পড়ি. এর অন্যতম কারণ রিয়ালিজম আমাদের যে সরলরৈখিক বাস্তবতাকে বিশ্বাস করে শেখায়, তা এক আপাত শান্তির জগত. কার্যকারণ সূত্রের জগত. কিন্তু জীবন এর অনেক কিছুই কার্যকারণের ধার ধারে না. 
কিন্তু পদার্থবিজ্ঞানের অনিশ্চয়তা সুত্র যে আমাদের জীবনেও ভয়ংকর ভাবে বিদ্যমান, তা যদি আমরা অনুভব করি তাহলে মহা মুশকিল. কারণ আপাত বাস্তবতার কার্যকারণ সূত্রের এলাকা আমাদের এক নিরাপদ গন্ডির মধ্যে রাখে. আমাদের জীবন প্রকৃত প্রস্তাবে যেটা চায় তা হলো এক ধরনের সিকিউরিটি. বাস্তবিক হোক বা তা আধ্যাত্মিক হোক. কিন্তু জীবনের শূন্যতাকে অনুভব করা যায় তখনি যখন আমরা পারি এই কার্যকারণ নির্ভর জীবনের গোলকধাঁধা থেকে বেরিয়ে পড়তে. মজাটা এখানেই যে যাকে আমরা গোলকধাঁধা ভাবি তা আসলে গোলকধাঁধা নয়, বরং যা আমরা সরলরেখা ভেবে স্বস্তিতে থাকতে পারি, তা এক চরম অনিশ্চয়তা. এবং চরম গোলকধাঁধা. 
আমার বাইরে একটা জীবন চলছে যা আমার বয়স, আমার কাজ ইত্যাদি নিয়ে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছে আর আমার ভিতরে আরেক বাস্তবতা চলছে যা কোনো সময় সারণীর ধার ধরছে না. যা খুব এলোমেলো. অথচ ঘটছে. যা খুব অনিশ্চিত, অথচ মন কে উন্মুক্ত করে দিতে সক্ষম. এই চলন্তিকা সুলভ জীবনের বাইরে নিয়ে গিয়ে যা আমাদের ভাবতে করছে যে যে জীবনটা তুমি কাটাছ ভাই, তা খুব অকিঞ্চিত. এই শূন্যতাবোধ না এলে লিখব কী bhaabe ! কারণ শূন্যতার বোধি  তো মানুষকে কবিতার কাছে, ধ্যানের কাছে নিয়ে যায়. 
আর লেখকের কাছে ধ্যান মানে তো লেখাই.
অনেক প্রশ্ন. মনের মধ্যে. 
(ক্রমশ)

Comments

  1. "শূন্যতার বোধি তো মানুষকে কবিতার কাছে, ধ্যানের কাছে নিয়ে যায়" চমতকার উপলব্ধি, চমতকার লিখা।

    ReplyDelete

Post a Comment