এলোমেলো আমি -২৬


এলোমেলো আমি -২৬ 

জীবনটা খুব বিরক্তিকর ভাবে কাটছে। হেমন্তকাল তার সর্বস্ব নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। বছরটা বুড়ো হয়ে পড়েছে খুব। এই সময়ে মাথার ভিতরটা খুব জমে ওঠে। বিশেষ করে রাত মানেই খুব বিরক্তিকর। সন্ধে হওয়া মানেই এক অবসাদ এসে আঁকড়ে ধরে আমাকে। আমি এই অবসাদ থেকে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করি না। এখানেই মজাটা। আমি কি তবে ভীষন মাত্রায় দু:খবিলাসী? কিন্তু তা তো নয়। আমি যখনি খুব আনন্দে থাকি, তখন আমি বুঝতে পারি খুব ক্ষনিকের এই আনন্দ। বিষাদ আর অবসাদের মধ্যে  জায়গায় আসতে আসতেই কি তবে আমার  হেমন্তকাল ঘনিয়ে আসবে এরকম?
আজ সন্ধেবেলা মনে হচ্ছে আমার আর বিশেষ কিছু হবার নেই। জানি এই মনে হওয়াটা  খুব নেগেটিভ। কিন্তু কি করব? আমার যে সেরকমই মনে হচ্ছে। আর কি বা হবার আছে, থাকতে পারে? এই দিনগুলো আমার মনে হয় ভাবনাহীন ভাবে কাটিয়ে দেয়ায় ভালো। কারণ সত্যই আমার মনে হয় না আর  কিছু লিখতে বা ভাবতে পারব! সত্যি কি ভয়ংকর একটা জীবন কাটাচ্ছি  তাই না?সারাদিন আমি যা চাই না তাই করে বেড়াচ্ছি। সারাদিন ধরে আমার শরীরে এক যন্ত্র ঘুমিয়ে থাকে। তাকে যখন ধাক্কা দেওয়া হয়, তখন সে জেগে ওঠে। সময়ের নিয়ম অনুসারে, চাহিদা অনুসারে তাকে চলতে হয়।  চলাটা তার ইচ্ছেমত না হলেও সে তো তখন মডার্ন টাইমস -এর মত। অভ্যেস এবং ইনার্শিয়াতে চলছে, যার সঙ্গে তার মনের কোনো সম্পর্ক নেই। 
আমি ভেবে দেখেছি, আমার ভিতরের মানুষের সঙ্গে বাইরের পৃথিবীর কোনো সম্পর্ক নেই। ইটা একটা ঘটনা যে সমসময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে না পারলে সেই ব্যাক্তি ক্রমশই সমসময় থেকে অনেক দুরে সরে যায় এবং তার হয়ত মৃত্যুও হয় সকলের অজ্ঞাতসারে। মৃত্যু কি সকলের অজ্ঞাতসারেই হওয়া  ঠিক নয়? এই প্রসঙ্গে মনে পড়ল আবার একটি স্বপ্নের কথা। আমি কয়েকদিন আগে স্বপ্নে দেখছিলাম আমার বাড়ির যে একটা সুন্দর চন্দ্রমল্লিকা গাছ আছে, সে মারা যাচ্ছে আমি স্বপ্নে দেখলাম সেই গাছটি আমার মাথার   আমার কপালের উপর নুয়ে পড়েছে। আমার মাথার ভিতরে সে তার স্পর্শ রাখার চেষ্টা করছে। কিছু একটা বলার চেষ্টা করছে। আর একটা হাত, কার হাত তা আমার জানা নেই, সে গাছটাকে ধরে মাটি থেকে তুলে আমার বুকের উপর  দিল মৃত সেই গাছটার দিকে তাকাতে তাকাতে আমি  চিত্কার করে উত্ছি কিন্তু কেউ কোনো কথা শুনছে না। হঠাত আমি আবিষ্কার করলাম যে আমার হাত আর পা মাটির মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে। আমার আঙ্গুলগুলো থেকে তৈরী হচ্ছে শিকর। আমার পা থেকে বেরিয়ে পড়েছে শিকর। আমার মুখ হাত সব কিছুর রং কচি    সবুজের মত। তার পর আর কিছুই  জানি না।মানুষ তো এক রকমের গাছ। লিখেছিলেন কোনো এক কবি। মনে পরে গেল।
না ঠিক এভাবে জীবনটাকে কাটাতে চিনি আমি। সে এখন কি করছে? খুব রোগা হয়ে গেছে কি? 
এখনো কি তার আমার কথা মনে পড়ছে?
সেদিন দেখলাম আমার কথা মনে রেখে আমার এক বন্ধু বাংলাদেশ গিয়ে বরিশালের মঠ -এর ছবি আমাকে পাঠিয়েছে। কী ঘনিষ্ঠ ভাবে মঠ গুলি একে অপরের গায়ে গা লাগিয়ে শুএ আছে। যারা হয়ত কখনো কাছাকাছি আসার সুযোগ পায়নি তারা পাশাপাশি শুয়ে আছে। চারিদিকে গাছ। ঝরা পাতা এসে পড়েছে। আমার জানার খুব ইচ্ছে হয় ঠিক কেমন গন্ধ ওই জায়গাতে! কিন্তু সেখানে না গেলে গন্ধটা   না। যেরকমই  হোক আমার বিশ্বাস, গন্ধটা খুব মন কেমন করা। গন্ধটা খুব সুন্দর। খুব  গন্ধ। আমার জীবনে এই গন্ধ ঘুরে বেড়ে। আমি বিশেষ করে এই হেমন্তকালে সেই একাকী গন্ধটা পাই। আমি দেখেছি আমার জীবনে, যে হেমন্তকালের সঙ্গে আমার লেখালেখির একটা আশ্চর্য সুন্দর সম্পর্ক আছে। আমি এ সময়ে প্রবল বিষাদে থাকি। আমি জানি আমাকে অনেক মানুষ   আমি তার বা তাদের সময় দি। এই চাওয়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু আমি যে চরম এক অস্বাভাবিক প্রাণী। ক্রমশ এবং ক্রমশ   সম্পর্ক থেকে আমি    হয়ত দূরে সরে যাব। এখন মাঝেমাঝেই আমার সমস্ত সরির আর কোনো কাজ করে না। ইচ্ছে হয় এই যে লিখছি এভাবেই লিখতে লিখতে সব কিছু ভুলে যাওয়ার একটা জগতে পৌছে যেতে। ইচ্ছে করে এমন এক বেদনার মধ্যে মরে যেতে যাতে আর কোনো কথায় আমার মনে না থাকে। কিন্তু আমার মনে হয় জীবন মৃত্যুর চেয়ে অনেক বেশি নিষ্ঠুর। 
অবশ্যই জীবন মৃত্যুর চেয়ে অনেক বেশি নিষ্ঠুর। মৃত্যু আসে আর কলিং বেল না বাজিয়েই তার ইচ্ছেটা পূর্ণ করে চলে যায়।  জীবন  ধীরে  ভরে যে মানুষ সব হারিয়ে ফেলেছে, তাকে আরও বেশি রিক্ত করে মেরে   থাকে। একজন মানুষ যখন নিজে থেকেই বুঝে গেছে তার বেঁচে থাকা মানে আর সুধু বেঁচে থাকার জন্য বেঁচে থাকা, তখন জীবন তাকে খুরর কল দেখায় তাকে বোঝায় -- আশাবাদী হয়ে ওঠো। তোমার অনেক কিছু করার আছে। তোমার অনেক কিছু পাওয়ার আছে, দেবার আছে। এসবি ভুল। কিন্তু মানুষ বিশ্বাস করতে চায় যে যাবতীয় বিষাদ সত্তেও আসলে তার অনেক কিছু করার আছে। এই যে অনর্থক বাক্যব্যয়, এই যে অনর্থক বেঁচে থাকার নিরন্তর চেষ্টা করে যাওয়া, এর মধ্যে যুদ্ধ করে তাকে বাঁচতে হবে। সে যে জীবনটা পেলে সত্যি কিছু করতে পারত, তা সে না পেলেও তাকে কষ্ট করে যেতে হবে সেই জীবনটা পাবার জন্য। 
আমি জানি এই যে বেঁচে আছি এটাই অনেক বেশি পুরস্কার কিন্তু এই বেঁচে থাকাটা পুরস্কার তাদের ক্ষেত্রেই যাদের আছে বেঁচে থাকার অন্য কোনো কারণ। সম্পূর্ণ বিষাক্ত একটা জীবন নিয়ে বেঁচে থাকাটা দুরারোগ্য অসুখে আক্রান্ত হয়ে বেঁচে থাকারই মতন। কিন্তু এই বেঁচে থাকার কোনো মানে আছে কি?
আমি সকলের মুখ দেখি। আমার  কালো সিনেমার মত লাগে। সকলের মুখে কি আশ্চর্য প্রাণশক্তি! তোমাদের প্রনাম জানায়। তোমরা পর বিষাদকে আড়াল করে বা ভুলে গিয়ে কিছু কিছু উদ্দেশ্য কে মাথায় রেখে বেঁচে থাকতে। কিন্তু যার সেই সব উদ্দেশ্য নেই সে কি করবে ?
আগামীকাল আর রবিবার আমার ছুটি।
আমি কি কোনো তীব্র ঘুমের ওষুধ  খেয়ে 
ঘুমিয়ে থাকব ?
(ক্রমশ)

Comments

  1. "ekhon jiban anek satej o shasthye bhara"--sandipan.so....

    ReplyDelete
  2. এলোমেলো আমি-২৭

    ততক্ষণে সন্ধে হয়ে এসেছে প্রায়। আমি হাঁটছিলাম কেদারের পথে। বিকেলে পৌঁছে গিয়েছিলাম গৌরীকুন্ডে। সেখান থেকে ৭ কিমি হেঁটে রামওয়ারা। ততক্ষণ পর্যন্ত বেশ জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হাঁটছি। সে নিয়ে আমার দ্বিতীয়বার কেদার যাত্রা। প্রথমবার অনেকে মিলে গেছিলাম। সেবার গেলাম একা। একা কেদার পাড়ি দেওয়া নিয়ে বাড়িতে বেশ ঝামেলা হয়েছিল। কিন্তু আমার মন চাইছিল গারোয়াল-এ হাঁটবো তো একাই। অনেকের সঙ্গে মিলেও একা। আবার একা গেলেও একা। তো কারোর না শুনে হাঁটতে লাগলাম। রামওয়ারাতে যখন পৌছলাম তখন চারদিক থেকে একটা ভিজে অন্ধকার ঘিরে ধরছে আমাকে। ওখানে ঠাই পেলাম বিরলা গেস্ট হাউস-এ। রাতে যখন খাওয়া দাওয়ার পরে বাইরে এসে দাঁড়ালাম, তখন চোখ পড়ল একটু নীচে। দেখি একজন মানুষ পাথরের ওপর বসে আছেন। বেশ খানিকটা নিচেই। আমি কৌতুহলী হয়ে নেমে গেলাম। অন্ধকার। পাথর দেখতে পাচ্ছি না। তার উপর একটু ভিজে ভিজে ভাব। যাই হোক পিছলে গেলাম না। যত এগিয়ে গেলাম, ততই স্পষ্ট হয়ে আসছিলেন যিনি বসে ছিলেন তাঁর অবয়ব। আমি ক্রমে ক্রমে তার প্রায় কাছেই হাজির হলাম। সেখান থেকে মন্দাকিনী প্রায় হাতের কাছে। কুলুকুলু স্রোত না। বেশ গর্জন। অন্ধকারে সেই গর্জন শুনে মনে হয় কে যেন দেকে যাচ্ছেন। সেই অতল জলের আহ্বান না শুনে আমি এগিয়ে গেলাম সেই ভদ্রলোকের কাছে। এমন একটা জায়গায় গেলাম যেখান থেকে হাত বাড়ালেই সেই ভদ্রলোককে স্পর্শ করা যায়। কিন্তু কি আশ্চর্য তাঁর কোনো সাড়া শব্দ নেই। আমিও তাঁর পাশে প্রায় বসে পড়লাম। তিনিও কোনো কথা বলছেন না। আমিও কিছু জিজ্ঞেস করতে পারছি না। ক্রমে সেই চারিদিকের গন্ধ, আলো-অন্ধকার আমাকেও আনমনা করে দিল। নীচে জলের গর্জন তখন বেশ সঙ্গীতের মত লাগছে। ঠান্ডা বেশ। কিন্তু চারিদিকে ভয়ের লেশমাত্র নেই। যেন কেউ ঘিরে রেখেছে আমাকে তখন। কে যে ঘিরে রেখেছে তা জানি না। ঘোরতর নাস্তিক আমি। ঈশ্বর ইত্যাদির কথা কখনো মনেও পড়েনি। কিন্তু এই টুকু বুঝতে পারছিলাম আমি অন্য কোনো এক অনুভুতিজগতের মধ্যে এসে পরেছি। ক্রমশ বুঝতে পারলাম আমার কোনো জিজ্ঞাসা নেই। আমার কোথাও যাবার কথাও নেই। মন খারাপ না। কান্না না। ভয় না। অন্যরকম এক অনুভূতির মধ্যে ডুবে গেছি তখন। আর আশ্চর্যের ব্যাপার সেই ভদ্রলোক যেমন পাশে বসে থেকেও আমার দিকে তাকালেন না পর্যন্ত, তেমন আমিও ক্রমশ ভুলে গেলাম তার অস্তিত্ব। বেশ কিছুক্ষণ পর যখন সম্বিত ফিরল দেখলাম তিনি নেই। হয়ত উঠে চলে গাছেন। ঘড়িতে রাত দুটো। অসম্ভব ঠান্ডা। সেই ভদ্রলোক কোথায় গেলেন? জানি না। দেখলাম উঠতে বেশ বেগ হলো।
    সকালে উঠে সেই কেদার। সেই অসম্ভব সুন্দর জগত। তার পর দিন বাসুকিতাল।
    কিন্তু রামওয়ারাতে সেই অভিজ্ঞতা আমি কখনো ভুলব না।
    কিন্তু আজ হঠাত মনে করে লিখলাম কেন? আমি গতকাল রাতে স্বপ্নে দেখেছি সেই ভদ্রলোকটিকে। সেই মন্দাকিনীর জলের পাশে ঠান্ডা ভিজে কিছু একটা আমাকে ঘিরে ধরেছিল। আমি দেখলাম আমি আবার তার কাছে বসে আছি সেই রাতে। শীতের বাতাস আমার মুখ চিরে বেরিয়ে যাচ্ছে। আমার হুঁশ নেই। এদিকে আমার প্রানের এক মানুষ আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। ঠিক মুখের সামনে কিন্তু আমার কোনো হুঁশ নেই। আমিও পাথরের উপর বসে আছি। একদৃষ্টে তাকিয়ে আছি জলের স্রোতের অন্ধকারে।
    গতকাল রাতে ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল আমার।
    গতকাল সন্ধেবেলা অনির্বান এর সঙ্গেও আড্ডা হলো খুব। তার সিঙ্গালীলা ঠাকুর কাব্যগ্রন্থের অনেকগুলো কবিতা শুনলাম। বইটি প্রকাশিত হবে। অনির্বানের বেশ কিছু কবিতা মুখস্থই থাকে বলতে গেলে।স্বয়ং এক পান্ডুলিপি। আমার অন্যতম এক প্রিয় বন্ধু।
    মনির বইটা নিয়ে কথা হলো। পুজোর আগে বেরোনোর নাকি কথা ছিল। কিন্তু বেরোলো না তো? মনি বোধহয় হাল ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু বইটা বেরোনো দরকার।
    কিন্তু আমি সেই ছয় বছর আগেকার অভিজ্ঞতাকে আবার কাল রাতে ফিরে পেলাম কেন?
    মনটা একটু বিষন্ন অবস্থায় রয়েছে। শরীরও ভালো নেই।
    বেশ কয়েক বছর কোনো কথা না বলে থাকতে ইচ্ছে করছে।
    ওহো! আমার আরো একটা কবিতার বইয়ের পান্ডুলিপি তৈরী। নাম দিয়েছি ব্যাক্তিগত নির্বাসন থেকে। এই ব্যাক্তিগত বানানটা এই ফন্ট এ কিছুতেই আসে না। ভারী বিপদ!
    নির্জনতা, এস।

    (ক্রমশ)

    ReplyDelete

Post a Comment