এলোমেলো আমি-২৫


এলোমেলো আমি-২৫

আজ সকালে একা মোর গানের তরী শুনতে শুনতে মনটা কোথায় হারিয়ে গেল। এ এক অদ্ভুত গান। গানটি ফেসবুকে পোস্ট করেছিলাম। তাতে একজন বিষাদে আচ্ছন্ন হয়ে আমাকে বলেছেন এ ধরনের গান আর পোস্ট না করতে। এটা শোনার পর থেকেই আমি গানটা নিয়ে ভেবেই চলেছি। কি আছে এই গানটিতে যে একজন গানটি থেকে পালিয়ে বাঁচতে চাইছেন? আমি আবার আজ গানটা শুনলাম। আর আশ্চর্যের ব্যাপার, গানটা শোনার পর আমার কোনো অবসাদ এলোনা। বরং আমি হারিয়ে গেলাম গানের ভিতরের জগতে। একা গানের তরী ভাসিয়ে একজন নদীর ধরে   হঠাত  একজন এলেন, যিনি গানের সেই নৌকাকে নিয়ে ভেসে পড়লেন। আর  যাতে ভেসে পড়তে পারেন সে কারণেই আমি গানের তরীকে ভাসিয়েছিলাম নয়নজলে। আমাদের চোখের জলের যে নদী, সেই নদীর বুকে নৌকা নিয়ে ভেসে পড়তে কে অপেক্ষা করে থাকেন ? কে আসেন সহসা? আর কার জন্যই বা আমাদের যাবতীয় শিল্প নিয়ে আমদের তরী অপেক্ষা করে থাকে? সে কি মৃত্যু? সে কি সময়? আজ সকল থেকে আমি প্রায় কিছুই করে উঠতে পারিনি। রক্ত মাংসের জন্য একটি গদ্য লিখছি সুনীলদার উপর। কিন্তু সেই গদ্যটাও লিখে উঠতে পারছি না। সকল বেলাতে উঠেছিলাম সেই লেখাটা লিখব বলে। পারলাম না। এই একটা গান আমাকে থামিয়ে দিল। মনে হলো আমাদের এই সব শব্দ, সব লেখা , অনর্থক কথা বলে যাওয়া। এগুলো থেকে মুক্তি নিয়ে অন্য কোথাও চলে যাই। যেখানে কথা বলার নেই। যেখানে চুপ করে থাকার আছে কিছুক্ষণ। যেখানে নিজের ভাবনার সঙ্গে বসবাস করার আছে। 
গতকাল তন্ময় বসুর সঙ্গে মেজাজ নিয়ে কথা হচ্ছিল। একটি টিভি কমার্শিয়াল নিয়ে মিটিং-এ এসেছিলেন তান্ময়দা, অভীক দা। আলোচনা হচ্ছিল ঋত্বিক ঘটক কে নিয়ে। সেই সূত্রেই আলোচনা চলে এলো উত্তর কলকাতায় এলো মন্থরতা বিষয়ে। তান্ময়দা একটা কথা বললেন যেতো ভাবার মত। এই সময়ে প্রায় করর মধ্যে সেই সময়টা নেই যে সময়ে তারা রাগ সঙ্গীতের ক্ষেত্র নিয়ে ভাবতে পারে। মানে রাগ সঙ্গীত কে বুঝতে গেলে আমাকে তার আলাপ , ঝালা সব কিছুই জানতে হয়। কিন্তু মানুষ এখন চটজলদি সব কিছু চায়। আর আরো একটা ব্যাপার হলো সব মানুষের মধ্যেই একটি বিষয় চলে এসেছে যে তাদের সব বিষয়েই মন্তব্য করতে হবে। কোনো বিষয়কে না জেনেও মন্তব্য করতে হবে। এই সোসাল নেট ওয়ার্কিং সাইট গুলিতে চটজলদি মন্তব্য বা পছন্দ ছুঁড়ে দিলেই তার কাজ শেষ। রাজনীতি থেকে সামাজিক সমস্ত বিষয়ে, শিল্প থেকে বিজ্ঞানে, লাইক এবং মন্তব্যের পরেই তারা আর ভাবতে উত্সাহী নয়। ইটা একদমই এই প্রজন্মের বিষয়, কিন্তু এই প্রজন্মের এই অভ্যাসের মধ্যে যে অসংখ্য মধ্যবিত্ত মানসিকতা সম্পন্ন মানুষ এতদিন ধরে নিজেদের তাত্ক্ষনিক অভিপ্রায়্গুলিকে প্রকাশ করতে পারছিলেন না, তারা পেয়ে গেছেন তাদের আত্মপ্রকাশের রাস্তা। আপাত দৃষ্টিতে এটা  ভালো। কিন্তু যখনি বিষয়টি নিয়ে ভাবার প্রসঙ্গ চলে আসবে, তখন বলতেই হয়, এর মত ক্ষতিকারক দিক আর কিছু নেই। আগে একটি কবিতা লেখার পর কবিকে বাধ্যতামূলক ভাবেই লেখাটি নিয়ে বসে থাকতে হত হয়ত বিভিন্ন কাগজগুলি থেকে লেখাটি ফিরত চলে আস্ত। আমরা তো পরেছি যে আগে বুদ্ধদেব বসু এক একটা কবিতা পরে তাঁর মতাৎ চিঠি লিখে পাঠাতেন কবিকে বা লেখক কে। সেই কবি বা লেখকের সঙ্গে কবিতা বা লেখাকে পরিমার্জনা করার বিষয়ে আলোচনা চলত। চিঠিতে। তার পর সেই কবি বা লেখক লেখাকে পরিমার্জনা করার পরে একটি স্বয়ং সম্পূর্ণ লেখা তৈরী হত। তার পর সেই লেখা প্রকাশিত হত। কিন্তু এখন লোকে লিখে ফেলেই ফেসবুকে তুলে দিছে। ২৫০ লাইকপড়লেই তারা ভাবছেন কি না কি হয়েছে লেখাটির। এবং তাদের মধ্যে লেখাকে শুকোতে দেবার কোনো মানসিকতা কাজ করছে না। লেখাকে শুকোতে দিলে লেখা থেকে অনেক অনাবশ্যক মেদ ঝরে পরে যায়। আমার নিজের ক্ষেত্রেই বলতে পারি, জিজ্ঞাসা পত্রিকায় তখন সম্পাদক ছিলেন শিবনারায়ন রায়। আমি কবিতা পাঠিয়েছিলাম কিছ্হুদিন বাদে একটি চিঠি এলো। তিনি দেখলাম একটি দীর্ঘ চিঠি লিখেছেন আমাকে। তাতে আমার পাঠানো কবিতাগুলির মধ্যে কোন পাঁচটা কবিতা ছাপা হবে এবং কেন হবে, তার সঙ্গে , কোন কোন কবিতা কথাও ছাপা হবার যোগ্য না এবং কেন না, এবং কোন কোন কবিতায় কিরকম পরিবর্তনের কথা ভাবলে কবিতাগুলো প্রকাশের যোগ্য হে উঠতে পারে তার একটি বিনীত প্রস্তাবনা। এমন ভাবে লিখেছেন যে তাঁকে বন্ধুই মনে হবে, কোনো সম্পাদক না।  এমন উনি কিন্তু একজন প্রকৃত সম্পাদকের কাজটাই করলেন। 
এই সময়ে দাঁড়িয়ে এই ধরনের লোক আর খুঁজে পায়না। চারিদিকে এত পত্রিকা, যে কোনো একটা পত্রিকা কবিতা না ছাপলে সঙ্গে সঙ্গে অন্য কোনো পত্রিকায় চাপানো যাচ্ছে। এটা  খুবই ভালো একটা দিক যে পত্রিকা এবং ওয়েব পত্রিকার সংখ্যা বৃদ্ধিতে কত কবি মরে গেল চুপি চুপি একা একা-এর সম্ভাবনা আর নেই। আবার একই সঙ্গে তারা কবিতা ভালো করে লেখার আগেই কবি হয়ে উঠছে এটাই ভাবনার। আমি নিজেকে নিয়েও এই সময়ে ভাবছি। আমি ঠিক কি করতে চাইছি? আমাকে তো লিখতে হবে। আমি জানি সেখানেই আমার মুক্তি। এবং তার জন্য অযথা শব্দের অপচয় বন্ধ হওয়া দরকার। তার জন্য আবার নিভৃতে চলে যাওয়া দরকার। আমি ভাবছিলাম আমি হয়ত অনেকের থেকে দুরে বসে আছি কিন্তু আমি নিজের মধ্যেও ঢুকতে পারছি না হয়ত এই সব সামাজিক প্লাটফর্ম এর কারণেই। 
কিন্তু এই সব কথা এলো কেন? একা মোর গানের তরী থেকে। একা শব্দটা এখানে গুরুত্বপূর্ণ। ওই নদীর ধরে বসে থাকাটা এখানে গুরুত্বপূর্ণ। 
যারা আত্মজীবনী লেখার জন্য ছটফট করতে থাকে, তাদের কাছ থেকে মন্থরতা চলে যায়। আমরা যদি ভুলে যাই যে আমাদের রক্তের মধ্যে আছে নদীর জলের স্রোত, সেখানে ছলাৎ ছল শব্দ হচ্ছে আর তার সঙ্গে হয়ত সূর্য আস্ত যাচ্ছে, যেখানেই থাকি না কেন, আসলে একটা স্রোতের ধরে চুপ করে বসে আছি আমরা, তাহলে আমরা সমকালীন সময়ের দাস ছাড়া আর কিছুই হব না। আর আমার তাতেই আপত্তি এবং তাতে আমার মনে হয় জীবনের ক্ষয় হয় অনেক বেশি। জীবনের ক্ষয় করতে যাব কেন আমি? আমি তো অবসাদগ্রস্ত হতে চাইছি না। আমি ছিছি বিষাদের মধ্যে যে বড় দু:খের কথা আছে তাকে আমার সম সময়ের মধ্যে খুঁজে বের করতে। সে আছে। সে মাঝে মাঝে আসে। তার জন্য ওই অপেক্ষা করে বসে থাকতে হয়। না হলে সে তো পালিয়েই যাবে। 
আমি বোধহয় এতদিনে বুঝতে পারছি ভাস্করদার, অরুপদার, সন্দীপন দার জীবনটাকে। বুঝতে পারছি আমি কেন অনেক দিন কিছু লিখতে পারছি না। দেখি। আমার নিজেকে খোলনলচে পাল্টানো দরকার। মানে, আমার ফিরে যাওয়া দরকার আবার প্রথমে। যেন বা আমি এতদিনে কিছুই লিখিনি। জীবনের প্রথম কবিতাটা লেখা হয়নি এখনো। আমাকে ভুলতে হবে আর চোখ কান সমষ্টি ইন্দ্রিয় খুলে রাখতে হবে। আমাকে অপেক্ষা করতে হবে চুপ করে। বড্ড বেশি কথা বলছি আমি। আমাকে চুপ করে যেতে হবে। 
আর তা না হলে এমনি যেমন আছি, তেমন ভাবে না ঘরকা, না ঘাটকা হয়ে কাটিয়ে দিতে হবে একটা গত জীবন। আমি বুঝতে পারছি আমি বিচ্যুত হয়েছিলাম। আশা করি আমি ফিরে আসতে পারব। 
নিজের ভিতরের এই ছটফটানি কিসের জন্য? 
শান্ত অবস্থায় অস্থির হাত কি যায় না?
গাছের পাতার মত? যখন সে রান্নাঘর, তখন সে শান্ত। সে তো মৃত্যুর আগেই শুকিয়ে গিয়ে ছটফট করতে থাকে। এই মৃত্যু তো আমি চাইনি। চাই না। 
(ক্রমশ) 

Comments