এলোমেলো আমি-২

এলোমেলো আমি-২

আজ সকাল থেকে মনটা খারাপ হয়ে  আছে. আমি স্বপ্নে দেখলাম আমি একটা অন্ধকার রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি আর একটি ট্রাক এসে আমার সামনে দাঁড়ালো. ট্রাক থেকে নেমে এলেন কিছু লোক. তাঁদের আমি চিনি না. আমার সামনে এসে বললেন, সময় হয়ে গেছে, তুমি কলিং বেল বাজিয়ে দিয়েছ. আমরা এসে গেছি. আমি জিজ্ঞেস করলাম - আপনারা কে? আমাকে জবাব দিল না. তাঁরা আমাকে জোর করতে লাগলেন. আমার হাত পা বেঁধে দিলেন. তার পর ট্রাক'এ ছুঁড়ে ফেললেন. ট্রাক  চলতে শুরু করলো. আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল. আমি মাঝেমাঝেই এরকম অদ্ভুত অদ্ভুত কিছু স্বপ্ন দেখি. তবে বাবা যেদিন মারা গিয়েছিলেন, সেদিন কেন যে এমন স্বপ্ন দেখেছিলাম জানিনা. দুপুরে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম.  অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকা সেই তখন থেকেই আমার অভ্যেস. তো, দুপুরে ঘুমিয়ে দেখেছিলাম বাবা একটি সাদা কাপড় পরে নদীর জলে তর্পণ করছে. মাথা ন্যাড়া. আমার বাবা ছিলেন এসবের বিরোধী. যে কারণে, বাবা মারা যাওয়ার পরে আমিও শ্রাদ্ধ করিনি. সে কারণে সমালোচিত-ও হয়েছি অনেক. কিন্তু আমার কাছে মনের শ্রদ্ধাটাই আসল. সেই কবে বাবা আমাকে বলেছিলেন মন যেটা চাইবে সেইটা করবি, মন যা চাইবে না তা করবি না. কিন্তু মুশকিল হলো এই যে, মন যা চায় তা কখনো কখনো হয়, কখনো কখনো হয় না. আবার মন যা চায়, তাকে অনুসরণ করতে গেলে আমাকে এমন সব দ্বন্দের মুখোমুখি হতে হয়, যেখানে মানুষ মানুষ কে ছেড়েও চলে যায়. 

মনে পড়ছে গোমুখ থেকে কালিন্দী পাস হয়ে বদ্রিনাথ আসার কথা. সামনে শিবলিং, অসংখ্য শৃঙ্গ, তারই মাঝখান দিয়ে আমরা চলেছি. চতুরন্গী গ্লেসিয়ার পার হয়ে হাঁটার কথা. এক চন্দ্রালোকিত রাতে, আমরা যখন ঢালু রক্তবরণ গ্লেসিয়ার-এ রাতে তাঁবু খাটিয়ে শুয়ে আছি, সে সময়ে হঠাত করে আমার ইচ্ছে করে বাইরে যাব. এই চন্দ্রালোকিত রাতে ঝকমক করে ওঠা পাহাড়গুলো দেখব. বাইরে গিয়ে দাঁড়িয়েছি. এমন সময়ে প্রচন্ড বিস্ফোরণের শব্দ. দেখি একটা পাহাড়ের মাথা থেকে ঝরনার জন্ম হয়েছে. দুধ গলা জল নেমে আসছে. আমি তাকে আরও ভালোভাবে দেখার আগ্রহে এগিয়ে গেলাম. কিন্তু কে জানত এমন বিপদে পড়ব! আসলে ওটা ছিল অভালাঁশ. এই রাতে চাঁদের এল আছে ভেবে আমি তো পাহাড়ের পাড়া বেড়াতে বেরোলাম. কিন্তু কে জানত আলো থাকলেই অন্ধকার থাকবেই সেরকমই. আমি অন্ধকারে গেলাম হারিয়ে. সে মনে আছে. একটা জায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছি. কোথায় পা ফেলবো তো বুঝতে পারছি না. কাউকে ডাকলেও সে সাড়া দিছে না. স্বাভাবিক. সারাদিনের পরিশ্রমের পর ঘুমিয়ে পড়েছে. কিন্তু ধৈর্যই আসল. আমি তো দাঁড়িয়েই রইলাম. আর চাঁদ তো আর দাঁড়িয়ে রইলো না. সে তো এগোচ্ছে. এগোতে এগোতে আলো ফেলছে অন্ধকারে. এমন ভাবেই আমি যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম সেখানেও এল এলো. আর আমি দেখলাম, আমি যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম, তার কিছু হাত দূরেই ঢালু খাদ. কত নীচে যে নেমে গ্যাছে তা জানি না. অর্থাত সেদিন ধৈর্য না ধরলে মৃত্যু ছিল অবশ্যম্ভাবী. 

এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে দুজন মানুষের কথা. যাঁরা আমাকে বারবার বলতেন ধৈর্য ধরার কথা. নিশ্চেষ্ট হবার কথা. তাঁরা কবি ভাস্কর চক্রবর্তী এবং গদ্যকার অরূপরতন বসু. এই দুজনের কাছেই আমি মাঝেমাঝে যেতাম. ভাস্করদা তো আমাকে হাতে ধরে কবিতা কীভাবে এডিট করতে হয়, তা শিখিয়েছেন. আর অরুপদার বাড়ি যেহেতু ছিল আমার বাড়ির কাছেই, বাঙ্গুর-এ, তাই সকল দশটা হলেই আমি চলে যেতাম তাঁর কাছে. তখন আমি চুটিয়ে টিউশানি করি. অরুপ্দাই আমাকে বলতেন, ধৈর্য ধর. লেখাকে জন্মাতে দাও. লেখাকে আদর কারো, নির্মম ভাবে লেখাকে কেটেও ফেল. কিন্তু কিভাবে কাটব ? কীভাবে  লেখাকে নির্মেদ করব? এ শিখ্যা আমাকে দিয়েছিলেন ভাস্করদা. মনে আছে আমার একটু এক পাতার লেখাকে নির্মম ভাবে ছেঁটে ফেলে উনি ৫ লাইনের করে দিয়েছিলেন. তুমি, অরক্ষিত কাব্যগ্রন্থের অনেক কবিতাতেই যাঁদের অপারেশন  আছে, তাঁরা ভাস্করদা, অরুপদা, জয়দা এবং  সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়. 

 এই সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় এবং অরুপদা যে আমাকে কত বই পড়িয়েছেন! আমার প্রিয় দুই বন্ধুর কথাও লিখব কবিতা জগতের. অনির্বান বন্দোপাধ্যায় এবং সার্থক রায় চৌধুরী. সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় আমাকে একবার বলেছিলেন কবিতা হলো বুকে হেঁটে পাহাড়ে চড়ার মত সময়সাপেক্ষ. দরকার ধৈর্য. দরকার জার্নি, দরকার নিজের সঙ্গে কথা বলা. অরূপ দার সঙ্গে আড্ডা দিতে দিতে আমরা চলে যেতাম কতইনা  জায়গায়. সবাই চলে গেছে. অনির্বান আর সার্থক নিজের জগত নিয়ে আছে. আর তেমন আড্ডাও হয় না. আর খুব মনে পড়ে গার্গী কে. 

সে এক অন্য গল্প. 
এখন অফিস যাবার সময় হলো. থামতেই হচ্ছে. অনেক কথা জমে আছে. সেগুলো বলব. কারণ কে জানে, হয়ত আমার সময় হয়ে এসেছে. আমি বুঝতে পারি.
কিন্তু জীবনের এমন কোনো সীমারেখা নেই, যেখানে এসে নিজেকে বলা যায় আর ভালোবেসো না কাউকে. কী করব! আমি কবিতা লিখি,সামান্য হলেও. আর তাই আমি প্রেমিক. আবার প্রেমিক বলেও লিখি. হয়ত প্রেমের কবিতা অত আসেনা আমার. কিন্তু কোনটা প্রেমের কবিতা আর কোনটা প্রেমের কবিতা নয়, তা কে ঠিক করবে?
(ক্রমশ) 

Comments

  1. Bhalo lagchhe Hindol, good on you...tobe kichhu banan adbhut lagchhe dekhte. Anirban ki ei lekhata dekhechhe? Sarthakdar ki khabor? Bhashkarda aar Sandipaner khabor to aar keu dite parbe na!

    ReplyDelete
  2. Bananer bishoyti aar ki kori.. i font e kichhute manage korte parchhi na. Aboshyo just likhchhi toh.. Anirban bhalo achhe. Ore ekta boi agami boimelate berobe. Sarthak ke katobar bolchhi...aboshyo amar sange anekeri ekhon jogajog nei. Aar Arupda, Sandipanda, Bhaskardar sange sei sob dingulo ki bholar!

    ReplyDelete

Post a Comment