এলোমেলো আমি


এলোমেলো আমি 

কিছু বিষয় আছে যেগুলির স্মৃতি মনের ভিতরে এত টাটকা থাকে যে মনে হয় সেগুলি এই কিছুক্ষণ  আগে ঘটল.  আবার এমন সব অভিজ্ঞতাও জীবনে ঘটে যেগুলি কেন ঘটল তার কোনো উত্তর পাওয়া যায় না.  আমার বিশেষ ভাবে মনে হয় পুরো জীবনটাই একটা ভীষণ দুর্ঘটনা. জন্মের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত নানা রকমের ঘটনা আমাদের জীবনে ঘটে চলে, আমরা সেগুলির কার্যকারণ সম্পর্ক খোঁজার চেষ্টা করি. কিন্তু জীবনের কোনকিছু ঘটার কোনো কার্যকারণ আদৌ আছে কি? ভ্রূণ জন্মের আগে কোন স্পার্ম এবং ওভাম মিলেমিশে আমাকে তৈরী করবে তা সম্পূর্ণ অনিশ্চিত থাকে. সেই বিশেষ স্পার্ম এবং ওভাম যদি না মিলিত হত তাহলে আমি না অন্য কেউ জন্ম নিত. সে হত আমার চেয়ে একদম আলাদা. তাহলে জন্ম থেকেই আমি অনিশ্চিত. জন্ম থেকেই কোনো না কোনো প্রবাবিলিটি ফ্যাক্টর আমাদের নিয়ন্ত্রণ করছে বা বলা ভালো আমাদের জীবনে ঘটে চলেছে. গতকাল একজনের সঙ্গে তর্ক হচ্ছিল আত্মা নিয়ে. তার দৃঢ় বিশ্বাস আত্মা আছে. আমার মনে হয় লীন হে গেলে তারা তখন তো মৃত, মৃতের এ পৃথিবীতে ফেরে না কখনো. এই লেখাতে যেহেতু কোনো ধারাবাহিকতা বজায় রাখবার যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই, তাই একদম আমার মন যেভাবে ভ্রমন করছে আমি সেভাবেই লিখছি. আমি এই লেখাটি সেভাবেই লিখে যাব. কারণ আমার মনে হয় কথাও আমার মনের ভাবনাগুলিকে লিখে রাখা জরুরি. এই মুহুর্তে আমারে মন চলে গেল বাবার মৃত্যুর দিনে. বাবা সকালবেলা খুব সুস্থ দেহে বেরিয়েছিলেন. 
 সন্ধেবেলা এসে আমাকে পড়ানোর কথা ছিল. আমার সামনেই ছিল মাধ্যমিক. সন্ধেবেলায় সহসা একটি ট্যাক্সি  এসে থামল আমার বাড়ির সামনে. অনেক লোক. সবাই-ই পাড়ার. আমি দৌড়ে নীচে নেমে গেলাম. দেখলাম বাবা হাঁপাচ্ছে. আমাকে দেখতে পেয়ে আমার হাতটা ধরলেন এবং এলিয়ে পড়লেন ট্যাক্সির মধ্যেই. নিমতলা ঘাটে যখন বাবার শরীর নিয়ে আমরা পৌঁছলাম তখন লাইন. অদ্ভুত একটা ব্যাপার দেখলাম. বাবার আগে ছিল একটি ৬ বছরের বাচ্চা আর বাবার পরে ছিল একটি অত্যন্ত জীর্ণ বৃদ্ধ. মনটা অদ্ভুত শান্ত হয়ে গেল. তার পর বাবার শরীর যখন পুড়ছে তখন আমি চুপচাপ বসে ছিলাম জানুয়ারী মাসের রাতে গঙ্গার ধারে. কালো জল বয়ে যাচ্ছিল. আর আমার মনের ভিতরে কোনো শক নয়, জন্ম নিছিল অদ্ভুত প্রেমের অনুভূতি. বাবাকে আমি খুব ভালবাসতাম. আমার জীবনের প্রথম বন্ধু বাবা. সেই বন্ধু নেই. আর কোনদিন ফিরেও আসবেন না. অথচ আমার মনের ভিতরে কেন এক অদ্ভুত শান্তি আসছিল? কেন আমার মনে হচ্ছিল এবার বাবা আমার সঙ্গে চিরকাল থাকবেন? প্রতি মুহুর্তে থাকবেন? সেই আমার জীবনের প্রথম কবিতা লেখা. আমার মনে পড়ছে সেই কবিতাটি আমি দেশ পত্রিকায় পাঠিয়েছিলাম আর তা ছাপাও হযেছিল. কবিতাটির নাম ছিল বৃক্ষ. একটি সনেট. তার পর থেকে আমার জীবনে শান্তভাবে প্ল্যান করে যুক্তিসঙ্গত ভাবে কিছু করার গঠনটাই উড়ে গেল. আমি নিজেকে ছেড়ে দিলাম. আমার সঙ্গী ছিল কিছু বই আর আমার নিজের খাতা. আমার কলম. কলম বদলে এখন কি বোর্ড হলেও বিষয়টি একই আছে. আর ঠিক এই বিষয়টি আমি কাউকে বোঝাতে পারিনা. আমি যতক্ষণ আমার নিজের মধ্যে থাকি, ততক্ষণ আমি যথেষ্ট সুস্থ একজন ব্যাক্তি. কিন্তু মানুষের কাছাকাছি গেলেই আমার ভিতরে নানারকম সত্তার আবির্ভাব হয়. এতে কষ্ট পায় আমার সঙ্গে যারা বন্ধুতা করেন তারা. আমাকে যারা ভালবাসেন আমি তাদের ভালবাসার সঠিক মর্যাদা ফিরিয়ে দিতে পারি না. কারণ কথাও আমি একা বাঁচি. একা মরি. 
হয়ত আমি খুব স্বার্থপর. হয়ত আমি ভালবাসা বুঝি না. হয়ত আমি কিছুই লিখতে পারব না. আসলে মানুষ কি আদৌ কিছু লেখে? লেখা অপেক্ষা করে থাকে এই প্রকৃতিতে. আধার পেলে তার মাধ্যমে লিখিত হয়. এই যে সুমন লিখলেন অসংখ্য অসামান্য গান, সে কি উনি নিজে লিখলেন? উনি নিজের আধারটাকে এমন ভাবে তৈরী করেছেন যে গান, সুর নিজে থেকে তাঁর কাছে এসে ধরা দিয়েছে. রবীন্দ্রনাথকেও তো বলতে হযেছিল 'আমি কান পেতে রই....মাঝে মাঝে তার বারতা আমার ভাষায় পায় যে কথা'... কত বড় মাপের কথা... মাঝেমাঝে তার বার্তা আমার ভাষায় কথা পাছে. এই সে টি কে? ঈশ্বর? সময়? প্রকৃতি? জানি না. ইশ্বর করুন যেন কোনদিন না জানতে পারি. এই বার্তা পাওয়াটাই মনে হয় বিপন্ন বিস্ময়. বোধ. ব্যক্তিত্ব. জীবনানন্দ, শক্তি, বিনয় মাথার মধ্যে হানা দিয়ে গেল. আমি যখন অফিসে যাই, তখন আমার সামনে থাকে সকল নটার সকাল. যখন বাড়ি ফিরি, তখন পাশে থাকে রাত দশটার আলো অন্ধকার. আমি অপেক্ষা করে থাকি. সে কখন আসবে.. কখন আসবে... কি লিখব আমি? আমার আধারটা কি তবে তার জন্য উপযুক্ত নয়? আমার লেখা কি তবে শেষ হয়ে গেল? আমি তো আর অন্য কোনো ভাবে নিজেকে প্রকাশ করতে পারি না. এও কি একধরনের মৃত্যু? 
লিখে যাব. এমন উল্টোপাল্টা ভাবেই না হয় এখন লিখে যাব. আমার ভালবাসা আমাকে ভুল বুঝেছিল. আমি প্রেমিক হিসেবে, মানুষ হিসেবে, জীবনসঙ্গী হিসেবে, বন্ধু হিসেবে, সন্তান হিসেবে হয়ত অনেক খাটো. হয়ত ব্যর্থ. হয়ত আমার গোটা জীবনটাই ব্যর্থ. 
কিন্তু আমি তো আদৌ সফল হতে চাইও নি! ( ক্রমশ)

Comments