Jagotgouri Kabyo nie ANANDABAZAR PATRIKAY ALOKERANJAN DASGUPTA-er review

পুস্তক পরিচয় ১...
‘জানো তুমি, আমি অন্য ধাতু’
অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত
জগৎগৌরী কাব্য, হিন্দোল ভট্টাচার্য।
একালের রক্তকরবী (পরি: মুক্তমন), ৬০.০০
তুন মিলেনিয়াম সূচিত হওয়ার মুখে সাহিত্য আকাদেমির প্রবর্তনায় ‘কবিতাচর্যা’ শীর্ষক যে কবিসম্মেলন ও কালান্তরের কবিদের অন্তরঙ্গ সংলাপিকা আয়োজিত হয়েছিল, সেখানে জন পনেরো কবিতাব্রতী অংশ নিয়েছিলেন। হিন্দোল ভট্টাচার্য ওঁদেরই এক জন।
ওই সংঘটনের পর ক্রমশই কবিতাপাঠের আসর থেকে হিন্দোল যে স্পর্শভীরু দূরত্ব বজায় রেখে চলেছিলেন, তার কারণ, তাঁর লক্ষ্য ছিল বিজনে নিরন্তর কবিতা রচনার অনধ্যুষিত পরিসর। সেই সুযোগেই আমরা পেয়ে গেছি হাওয়ার জ্যামিতি (২০০০), তুমি, অরক্ষিত (২০০২), আবার হেমন্তকাল (২০০৬) ও বীজমন্ত্রের মতো মিতাক্ষর তারামণির হার(২০০৮)। শেষোক্ত, প্রায় বাক্‌কুণ্ঠ, অঙ্গুলিমেয় বইটি দেখে কেউ- কেউ উনগারেত্তির, কেউ-বা হাইকু-পদাবলির অনুষঙ্গ আবিষ্কার করতে উদ্‌গ্রীব হয়ে উঠেছিলেন, কিন্তু কোনও অনুসন্ধানীই ধরতে পারেননি, পদকর্তা নিজেকে উজাড় করে দিয়ে অনতিরিক্ত অথচ ভরসাব্যঞ্জক একটি মনোভূমি নির্মাণ করতে চাইছিলেন। সে কি শিকড়ের আর্ত অন্বেষায়?
আনুমানিক নিশ্চিতি নিয়ে বলতে পারি, উত্তরগর্ভ এই জিজ্ঞাসাতেই আমাদের কৌতূহলের সম্ভাব্য নিরসন প্রচ্ছন্ন। এই মুহূর্তে জার্মান কবিতা থেকে বাংলায় অনুবাদ সংক্রান্ত একটি ওয়র্কশপে নিবিড়বৃত এই কবি ওই সন্ধিক্ষণে ইউরোপীয় কবিতার নাড়িনক্ষত্র যাচাই-জরিপ করে নেওয়ার পর স্বদেশে নোঙর করার জন্য অস্থির হয়ে পড়েছিলেন, পূর্বসূরি মধুসূদন তাঁর চতুর্দশপদী কবিতাগুচ্ছে যেমন। এই উচাটন আর্তি শুধু শব্দসন্ধিৎসায় নয়, অব্যবহিত পরিবিশ্বের উতরোল মন্থনে। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ সংগ্রহশালার শতবার্ষিক গ্যালারি যখন জায়মান, তার অন্যতম অন্তঃসাক্ষী তিনি। লক্ষ করছেন বিষ্ণু দে ও কমলকুমার মজুমদারের কৌমশিল্প সংগ্রহ কী ভাবে ঈপ্সিত
আধুনিকতার নব নব উন্মেষে চূড়ান্ত কাজে লাগতে পারে। তাঁদেরই ঐতিহ্যঘনিম চাহনিতে ইন্দোনেশিয়া থেকে প্রস্তরপ্রতিমা সঞ্চারিত হয়ে দেশজে সমীকৃত হয়ে উঠছে; মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী এবং রাজা রাজেন্দ্রলাল মিত্রের সংগৃহীত গান্ধার ভাস্কর্য বনে গিয়েছে বাংলার নিজস্ব সম্পদ। আর হরপ্রসাদ শাস্ত্রের লোকহিতায় উৎসর্গিত সেই বুদ্ধ মন্দিরের ঘণ্টার প্রাণস্পন্দন? বিষ্ণুপুরের শিল্প-সংরক্ত ফৌজদার পরিবারের দুর্গাপটচিত্র তো বটেই, সংগ্রহশালার কাঠ ও শোলার এথনিক শিল্পায়ন, রঘুনাথ গোস্বামীর তৎসংক্রান্ত দানসামগ্রী যাকে আরও ঋদ্ধ করে আধুনিক চিত্রকলার দিকে আমন্ত্রণী চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে? আর কোথা থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসল সরা ঘট আর লাক্ষাপুতুলেরা? আর কুমারটুলির ঘরোয়া ডৌল? পরক্ষণে ওড়িশার রতিমন্দির দশাবতার তাস? এ সবের দিকেই হিন্দোলের মন চেয়ে রয়, মনে মনে হেরে মাধুরী। কিন্তু তারাপদ সাঁতরা আর ডেভিড ম্যাকাচ্চন-এর প্রশ্রয়লালিত পোড়ামাটির সম্ভার কেড়ে নেয় শিকড় শরণার্থী কবির ঘুম। মনে রাখতে হবে, এই দু’জনকেই তিনি অর্পণ করেছেন তাঁর ধ্যানের ধন জগৎগৌরী কাব্য (২০০৯)।
উৎসর্গভাজন দ্বিতীয়োক্ত মানুষটি ছিলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক বিভাগে আমার সতীর্থ। এক সন্ধ্যায় হঠাৎই পোলিওপীড়িত ডেভিড হাজির আমাদের আস্তানায়। ভারি উত্তেজিত দেখাচ্ছিল তাঁকে। থরথরিয়ে কেঁপে বলতে থাকলেন: “জানেন, অলোকরঞ্জন, জানেন, লোকেরা বলছে আমি নাকি বেশ কিছু টেরাকোটার মূর্তি চুরি করেছি! যদি পারতাম লক্ষ লক্ষ বৈদেশিক মুদ্রা ভাঙিয়ে এ-সব মৃন্ময় নির্মিতি আমি ওদেশে নিয়ে গিয়ে ও-দেশের কবিদের কাছে প্রদর্শন করতাম, যেন ওরা ভারতীয় আধুনিকতার আস্বাদ নিতে পারে।” লজ্জায় অধোবদন হয়ে আমি মুমূর্ষু সেই জ্ঞানব্রতী সহকর্মীর পায়ের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
আজ জগৎগৌরী কাব্য হাতে নিয়ে আমার সেই সন্ধ্যার অসহায়তার শামিল হয়ে পড়ি। হাতের কাছেই হিন্দোলের সন্দর্ভ: ‘রামপ্রসাদ সেন: একটি অ-ঔপনিবেশিক পাঠ’, আমি বিক্ষিপ্ত উৎসারে, অনেকটা যেন পূর্বধার্য আধুনিকতার ফাঁদ থেকে নিষ্ক্রমণের গরজে, দু’য়েকটি জায়গায় চোখ বোলাই: “সাহিত্যে কী কী উপকরণ, বৈশিষ্ট্য থাকলে তাকে আমরা আধুনিক বলব, বা বলব না, তা স্থির করে দেয় ইয়োরোপীয় মডেল। সেই মডেলেরই অনুসারী ভাবনায় আমরা আধুনিকতার চিহ্ন বলে যে যে বিষয়গুলি নিয়েছি, সেগুলির সার কথা— বিষাদ, অমঙ্গলবোধ, অন্ধকার... কিন্তু যখন আধুনিক সময়ের যন্ত্রণাবোধ, নিঃসঙ্গতার সঙ্গে, অসুখ, অন্ধকার, বিষণ্ণতার মধ্যে মিশে যায় প্রকৃতির প্রসন্নতা, মিশে যায় বড় কোনো জীবনবোধের সংগীত, যেখানে ক্ষয়ের সঙ্গে, ক্ষয়িষ্ণুতার সঙ্গে নতুন কথা বলবার পরিসরটি তৈরি হয়।”
একাধারে নির্মম আত্মনগ্নায়ন এবং পরিণামী নির্মল দেবায়নের এই যুগ্ম প্রেক্ষিতে হিন্দোলের সনেট থেকে সনেটের বিতত ফ্রেস্কোয় অনন্যমনস্ক হয়ে পড়ি, আর ঠাহর করে নিতে পারি মধুসূদনের উন্মোচিত আঁজ়াবমা বা পঙক্তি-ছাপিয়ে-যাওয়া প্রবহমানতার তোড় থেকে উপচে-পড়া ঝিলকে-ওঠা এক-একটি ঝিনুক কী রকম স্বর্গাদপি গরীয়ান হয়ে উঠতে পারে:
‘...নক্‌শার পাশেই
রয়েছে শিল্পীর মন, নারী তার হাতে পো কাঁখে পো
চৈত্য গবাক্ষের গায়ে জীবনযাত্রার অবকাশে
চন্দ্র-সূর্য, দৈনন্দিন, ছাঁচ-ভাঙা, টেরাকোটা সাপও
ফুলবল্লী হয়ে আছে...।’
পরক্ষণে প্রশ্ন জাগে, জাগতেই পারে, পোড়-খাওয়া ভিটার বাস্তুসাপও এত গরিমা কী ভাবে অর্জন করে নিল? শুধু এ রকম উত্তরণের বিস্ময়ই নয়, উদ্ঘাটনের বীক্ষাও দেখতে পাই অন্যত্র:
‘হৃদয়ের বিষ
সাপের ছোবল হয়ে খুলে ফেলছে সমস্ত আড়াল-ও’।
অমঙ্গলের এ রকমই মঙ্গলাচরণে ‘পিঞ্জরাবদ্ধ শিশু’, নবদ্বীপের গাজনে কঙ্কালের পুজো-আর্চা, পোড়ামাটির ফলকে উৎকীর্ণ সারমেয়ের সঙ্গে একটি পুরুষের বীভৎস মিথুনক্রিয়াও এই কারণে কবির মমতা উদ্রেক করে যে, যেহেতু, দেশের মাটিতেও এ সবের সঞ্চার।
তবুও স্বভূমে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির নাগরদোলার চর্কিবাজি থেকে স্বকীয় তুলসীতলায় সর্বাত্মক প্রত্যাবর্তন এক হিসেবে, স্টাইলাইজ়ড বা মুদ্রাস্ফীত হলেও, কবিতার নিকটঘটনা। কী করে আমরা ভুলি, পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতোই আমাদের এই ভূখণ্ডেও ভাবুক মাত্রেই আজ অনিকেত, অন্তরিন? আর তাই তো তিনি যদি আত্মরক্ষার সৌজন্যে এখনও জীবিত লেভি ষ্ট্রাউসের কাছ থেকে চিন্তনের অস্ত্রশস্ত্র ধার নিয়ে বহিরাগত সভ্যতার বিরুদ্ধে প্রয়োগ করেন, তাঁকে আমরা কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে যাব কেন?
আমাদের এই সব খুঁতখুঁতে অস্বস্তির সঙ্গে যোগযুক্ত বলেই হয়তো আলোচ্য এই কবির কাছে আমরা অগুনতি নিকষোপম উচ্চারণ পেয়ে যাই:
‘এ কোন রাজার দেশ, এ কোন দেশেই পরবাসী?’
‘...তারই ফাঁকে স্তন্যদানরত
দশরথ মহিষীবৃন্দ’ ‘আমাকে শাসিয়ে গেলে— জানো তুমি, আমি অন্য ধাতু’
‘ভাস্কর আমার...
পোড়াও আমাকে, ছাঁচ করে তোলো এ পোড়া বাংলার’
‘জলচৌকির উপর মুখোমুখি বরবধূর কথা’—
শেষ লাইনটি মেদিনীপুরের একটি মন্দিরের গায়ে চিত্রার্পিত বিবাহ আলেখ্য, বরের মাথায় শোলার মুকুট আর কনের মাথায় সিঁথিমৌরের কী এক অনবদ্য মায়াবী সংস্থান!
বাংলা কবিতা যখন, বিশেষত গ্লানিকর চোদ্দোই মার্চের পর, আঙ্গিকের বিক্ষিপ্ত ঐশ্বর্য সত্ত্বেও, কিছু অবসন্ন কিছু পুনরুক্তিপরায়ণ হয়ে আছে, একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকের প্রাক্‌ তোরণে, একটি নতুন স্বরক্ষেপ আমরা সানন্দেবরণ করে নিলাম।

Comments

  1. অলোকরঞ্জন বই রিভিউ করলে তাঁর নিজস্ব গদ্যের ভুলভুলাইয়ায় যে বইটির তিনি আলোচনা করছেন তা হারিয়ে যায় । সত্যি কথা বলতে কি হিন্দোল, তোমার বইটি সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা গড়ে নিতে পারলুম না। আমার সব সময় মনে হয় যে বই রিভিউ করতে দেয়া উচিত নিজের চেয়ে কম বয়সী কাউকে।
    ভালো থেকো।
    শুভেচ্ছাসহ
    মলয়দা

    ReplyDelete
  2. Maloyda, aapni Kolkatay thakle aapnake boita pathie ditam. Aar Jagotgouri kabyo er kichhu kobita ekhanei paaben. Aapnar motamoter apekhyay thakbo.

    ReplyDelete

Post a Comment