এলোমেলো আমি -৩০ ইতিহাস-এর কাছে আমরা কি জবাব দেব বন্ধু?


এলোমেলো আমি -৩০


ইতিহাস-এর কাছে আমরা কি জবাব দেব বন্ধু?



শরদিন্দু বন্দোপাধ্যায় তাঁর চিড়িয়াখানা উপন্যাসে লিখেছিলেন - যে জাতি নিজেদের প্রতি শ্রদ্ধা হারিয়েছে তারা আর কাকে শ্রদ্ধা করবে? কথাটি ভাবার মত। নিজের প্রতি শ্রদ্ধা নিয়ে আসে নিজের মেরুদন্ডের জোর, প্রশ্ন করার ক্ষমতা, প্রতিবাদ করার সাহস। কিন্তু বাঙালি হিসেবেই শুধু নয়, এই দেশের নাগরিক হিসেবে আমি অনুভব করি এই যে, আমাদের নিজেদের প্রতি-ই আর কোনো শ্রদ্ধা নেই। থাকলে এত বেশি সহিষ্ণু হয়ে থাকতে পারতাম না আমরা। বিশেষ করে যখন অমানবিকতা এবং নৈরাজ্যে আমাদের সকলেরই পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। কিন্তু সত্যিই কি তাই? না কি আমরা রাষ্ট্রের পেতে দেওয়া ভোগের জালে আবদ্ধ হয়ে অনুভব-ই করতে পারছিনা কীভাবে, ঠিক কীভাবে আমাদের প্রতি মুহূর্তে ধর্ষণ করে চলেছে এই রাষ্ট্র। দিল্লিতে আমাদের বোন নির্ভয়ার মৃত্যু আমাদের এই প্রতি মুহূর্তে ধর্ষিত হয়ে চলা অস্তিত্বের এক রূপক। তিনি মারা গেছেন আজ। তাঁকে মানুষের বাচ্চারা নির্মম ভাবে হত্যা করেছে। কিন্তু শুধু কি তাকেই হত্যা করেছে? বা, নির্ভয়া কি একা ?
বেশ কয়েক যুগ ধরে ভারতীয় সেনাবাহিনী কাশ্মিরে, মনিপুরে, ছত্রিশগড়ে, মেঘালয়ে অমানুষিক নির্যাতন করে আসছে। গ্রামের পর গ্রামে মহিলারা ধর্ষিত হন, খুন হন, কেউ কিছু বলেন না। মনিপুরের মায়ের কথা নিশ্চই ভুলে যাননি কেউ। ভুলে যাননি নিশ্চই সেই নগ্ন হয়ে প্রতিবাদ! আমাদের এই রাজ্যে, আদিবাসী মহিলাদের ধর্ষণ করে ফেলে রাখা হয়। হত্যা করা হয়। কখনো তা শাসক বা বিরোধী দলের মদতপুষ্ট গুন্ডারা করেন, নেতারা করেন, আবার কখনো বা করেন আমাদের রক্ষকেরা। সেই রক্ষকদের মধ্যে যেমন আছে সেনাবাহিনীর সন্ত্রাস, তেমনি আছে পুলিশের আক্রমণ। অনেক খবর বেরয় না। অনেক খবর বেরিয়েও মানুষের স্মৃতি থেকে মুছে যায়। এই ভারতীয় গণতন্ত্র  তাদের তথাকথিত রক্ষক এবং দলতন্ত্রভজা সেই সব নেতাদের বিরুদ্ধে কিছুই করেন না। কারণ তাদের কিছু যায় আসে না।
নির্ভয়া একা নন। নন্দীগ্রামে, সিঙ্গুরে তত্কালীন শাসক দলের গুন্ডারা, পোষা পুলিশেরা গ্রামের মেয়েদের ধর্ষণ করেছিল। বাচ্চাদের ছাড়েনি। শুধু তাপসী মালিক-ই নন, প্রমাণ পাওয়া গেছিল এমন অনেক কিছুর, যা থেকে প্রমানিত হয়, সেদিন গণহত্যার পাশাপাশি চলেছিল গণধর্ষণ। শুধু নন্দীগ্রাম, সিঙ্গুরের কথায় বা বলব কেন? বীরভুম বাঁকুড়া, পুরুলিয়ায় কি হয়েছে? অনিতা দেওয়ান কে কি আমরা ভুলে গেছি? ভুলে গেছি অর্চনা গুহর কথা? জনকে রুনু গুহ নিয়গির মত পুলিশ অফিসার টানা এক মাস ধরে ধর্ষণ করেন। তাঁর নিম্নাঙ্গ সম্পূর্ণ অসাড় হয়ে যায়। জীবনটাই নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু আজ শুনি বিমান বসু রুনু'র সুখ্যাতি করছেন! হায় গণতন্ত্র!
পার্ক স্ট্রিট-এ যে মহিলাকে ধর্ষণ করা হয়, তিনি খারাপ চরিত্রের মানুষ বলে বদনাম দিয়ে ধর্ষণের যোগ্য এ জাতীয় কথা বলেন কিছু মানুষ ! স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী বলেন - সাজানো ঘটনা! বলেন ধর্ষিতাদের সরকার থেকে টাকা দেওয়া হবে! টাকা দিয়ে কী সম্মান ফিরত দেওয়া যায়! হায় আমাদের রাজ্যের বুদ্ধিজীবিরা! আপনারা পদের লোভে, পদ হারানোর ভয়ে আত্মা বিক্রি করে বসে আছেন! লিখবেন কি করে? গাইবেন কি করে? নাটক করবেন কি করে? ছবি আঁকবেন কি করে? কারণ শিল্প সৃষ্টি করার আগে তো নিজের দর্পণের সামনে দাঁড়াতে হয়। সেটাই তো পারবেন না। আরও কেউ কেউ তো ধর্ষণের পরিবর্তে টাকা দেবার ঘোষণাও করে রেখেছেন! অর্থাৎ যাদের টাকা আছে, তারা যাকে তাকে খুশি ভোগ করতে পারেন! হায়! আমাদের মুখ্যমন্ত্রী নাকি মহিলা! এবং দু:খের বিষয়, আজকের সংবাদপত্রে দেখলাম এক মহিলা বিধায়ক বলেছেন যে পার্ক স্ট্রিট-এ ধর্ষিতা হওয়া মহিলাটি আসলে ধর্ষিত হননি। তিনি তাঁর কাস্টমারদের সঙ্গে দর কষাকষি করছিলেন! রাজনীতি করতে গেলে কি এতটাই নির্লজ্জ এবং অশিক্ষিত হতে হয়?
দুর্ভাগ্যবশত আমরা তাদের কথা শুনি। আমাদের ঘেন্না হয় না। আমাদের সহিষ্ণুতা চরম। আমরা পারিনা তাদের সরাসরি বলতে- রাজা তোমার কাপড় কোথায়?
কথাও সব এক লাগছে না বন্ধু? সিপিএম, তৃনমূল, কংগ্রেস এক নয়? এক নয় আজকের বিপ্লবী সুলভ কথা বলা বিজেপির লোকেরা, যাঁরা বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার দাঙ্গায় এবং গুজরাটের দাঙ্গায়  নির্বিচারে ধর্ষণ করেন মুসলমান মহিলাদের। ছেলের সামনে মহিলাদের গণধর্ষণ করে তখন তো যৌনাঙ্গের মধ্যে ধারালো অস্ত্র ঢুকিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। আমরা কত সহিষ্ণু দেখুন! সেই গুজরাটের নরেন্দ্র মোদীকে আবার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে নিয়ে আসেন গুজরাট বাসীরা। আমাদের কাছে সেই গুজরাট নাকি এক আদর্শ রাজ্য!
আমরা তো এসব সহ্য করে এসেছি। আমরা তো সহ্য করেছি ভুবনায়নের নাম দুর্বিত্তায়নকে। আমরা তো পণ্য হতে চেয়েছি। বিক্রি করেছি নিজেদের। সাদরে আসতে দিয়েছি ভোগবাদী সংস্কৃতিকে। একটা সময় ছিল যখন আমরাও ছিলাম গ্লোবাল। এখন আমরা ভাবি আমরা ভোগ করছি, কিন্তু আমাদের ভোগ দেখে হাসে ভুবন কারণ তারা জানেন যে আমরা আসলে ভোজ্য। আমরা সহ্য করেছি নরেন্দ্র মোদীর হিন্দুত্ব। আমরা সহ্য করেছি ৩৪ বছরের সিপিএম-এর অপশাসন। আমরা সহ্য করেছি  দীর্ঘকাল ধরে কংগ্রেস নামক দলের নৈরাজ্য। এ রাজ্যে এখন  পরিবর্তনকামী নাম নিয়ে  আসা কুত্সিত দুর্বিত্তদের আমরাই তো সহ্য করে চলেছি এখনো। কোথায় আমাদের মেরুদন্ড? কেন আমাদের দেশে সেনাবাহিনীর লোকেরা গ্রামের পর গ্রামে মেয়েদের ধর্ষণ করবে? কেন দেশের সীমান্তে
বিএসএফ -এর সেনারা ভোগ করবে গ্রামের মেয়েদের। এবং ভোগ করে যদি তাদের মনে হয়, তবে খুন করতেও দ্বিধা বোধ করবেনা ! কেন আমরা পাড়ায় পাড়ায় , মোড়ে মোড়ে পর্নোগ্রাফির সিডি বিক্রি হওয়া নিজে থেকেই আটকাতে পারব না? কেন বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে চাকরি বাঁচানোর জন্য মেয়েদের বাধ্যতামূলক ভাবে ধর্ষিত হতে হবে উপরে থাকা বসেদের কাছে? কেন? শিক্ষাক্ষেত্র থেকে সংস্কৃতি,  অন্ধকার শুনশান রাস্তা থেকে নৈশ ক্লাব,---কোথায় হচ্ছে না ধর্ষণ? গ্রামের আদিবাসী মেয়েদের কথা কেন আসছে না? তারা আদিবাসী বলে? মনিপুর, কাশ্মীরের মেয়েদের কথা আসছেনা কেন? আসছেনা কেন শর্মিলা চানুর কথা? সনি সুরির কথা?
হাঁ,আমিও চাই নির্ভয়াকে যারা এভাবে হত্যা করলো, তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি হোক। কিন্তু আমরা কি চাইবনা এক নিরুপদ্রপ পৃথিবী জন্ম নিক? চাইবনা সভ্যতার এই সংকট দূর হোক আমাদের জীবন থেকে? চাইবনা একটু ভালো ভাবে, নিরাপদে বাঁচুক আমার মেয়ে? আমার মা এর দিকে একটু গর্বের সঙ্গে তাকাতে পারব না? আমার বোনের  জন্য একটু নির্ভর মনে থাকতে পারব না? আমার বান্ধবীর সাহসে জাগাতে  পারব না উত্সাহের স্পর্শ?
বড় লজ্জা করছে। রাগ হচ্ছে। কারণ আবার একটা নতুন বছরের উত্সব। মানুষ হয়ত সব ভুলে আনন্দ করবে। কিন্তু বন্ধু, একমাত্র গণ অভ্যুত্থান পারে ব্যবস্থার পরিবর্তন করতে। আমরা কি অনেক সহ্য করে ফেলিনি? নির্ভয়াদের মত আরো কিছু মৃত্যুর জন্য কি আমরা অপেক্ষা করছি? বিমান বসু, কাকলি ঘোষ দস্তিদার, মমতা বন্দোপাধ্যায়, শিলা দীক্ষিত, মনমোহন সিং, হেন তেন, এরা কথা বলে যাবে আর আমরা শুনে যাব? কতদিন?
অন্তত প্রশ্ন তো করতে পারি। আমার কবি বন্ধুদের কাছে এবং অনুজ বন্ধুদের কাছে প্রশ্ন আর কত দিন ? আমাদের মেরুদন্ড কি নেই?
আমরা কি শুধুই সহ্য করে যাব ? রোম যখন পুড়বে, তখন বেহালা বাজাব নীরোর মত? প্রেমের কবিতা লিখব? বানানো সাজানো গোছানো মিথ্যে কথা লিখে যাব?
অথচ কবিকে কি পারে রাষ্ট্র সামলে রাখতে?
দেয়ালে পিঠ ঠেকে  যাওয়া মানুষকে কি পারে রাষ্ট্র খুড়োর কল সামনে রেখে পোষ্য করে রাখতে?
ভয় দেখিয়ে দেখিয়ে মেরুদন্ড বাঁকিয়ে দিতে?
গান কেড়ে নিতে ?
চোখে ঠুলি পরিয়ে  রাখতে?
ইতিহাস-এর কাছে আমরা কি জবাব দেব বন্ধু? 

Comments