জাতিস্মর সৃজিতের ছবি? না কি স্বয়ং সময়ের?
জাতিস্মর সৃজিতের ছবি? না কি স্বয়ং সময়ের?
মাঝে মাঝে খুব হতাশ লাগতো। একটা গোটা জাতি আত্মবিস্মৃতির পথে চলেছে যখন, তখন মনে পড়ে, এই বাংলায় ছিল এক স্বতন্ত্র আবহমানতা। এক নিজস্ব আধুনিকতা। দেশজ আধুনিকতার সেই স্রোতের কথা শুনতে পেতাম না কোথাও। শুধু সময়ের গুনগুন ধ্বনির ভিতরে আবছা মনে পড়ত এক আবহের সুর। আবার সে যেন কোথাও হারিয়ে যেত। তাকে খুঁজে পেত না মন। সময়ের সঙ্গে বাজি ধরে পরাস্ত হওয়া এই অস্তিত্বর মধ্যে কোথায় যে লুকিয়ে আছে চিরসময় তা বুঝতে পারতাম না। কিন্তু নিশ্চিত ছিলাম সে আছে। আছে, তার কারণ সময় কখনো সরলরেখার পথে যায় না, থাকে না। থাকে স্পাইরাল ফর্ম-এ। অতীত মানেই সে মহাকালের গর্ভে চলে গেছে আর বর্তমান মানেই সে মুহূর্ত মাত্র, তা নয়। আমাদের আপাত বাস্তবতায় তা মনে হলেও অতীত কখনো শুধু অতীত নয়, আবার বর্তমান শুধু মাত্র মুহূর্তের খেয়া পারাবার নয়। আর এই ভাবনাই নিয়ে আসে এক অনন্তকালীন ইতিহাসবোধ। সমসময়ের মধ্যে চিরসময়কে খুঁজে পাওয়াই শিল্পের মূল কথা। এমনকী যে সময়ের কথা কেউ লিখছে বা এঁকে রাখছে, সেই সময়ের মধ্যে খেলা করে নানা সময়। এটাই ইতিহাসের আবহমানতা।
কিন্তু আমাদের বর্তমান সময় বড় আত্মবিস্মৃত। সে ভুলে থাকতে ভালবাসে। কারণ ভুলে না থাকলে তার অস্তিত্ব সংকট। যে অভ্যাসের জীবনযাপনে সে স্বস্তি বোধ করে, সেই জীবন আর সে যাপন করতে পারবে না, যদি সে কখনো নিজের মধ্যে খুঁজে পায় এমন কোনো বোধ, যা তাকে নিজের ইতিহাসের কাছে অনুগত হতে শেখায়। শেখায় এমন কোনো শিল্পযাপনের কথা, যেখানে ইতিহাস বর্তমানের আর বর্তমান, ইতিহাসের হাত ধরে রচনা করবে এক নতুন ইতিহাস। কিন্তু এ পথ বড় কঠিন। এ পথ আত্মবীক্ষণ'-এর। এ পথ খননের। এ পথ নিজেকে চেনার। আর তাতে অভ্যাসের জীবন বিপর্যস্ত হতে বাধ্য। বহুদিন বাংলা ছবিতে এই বিপর্যস্ত করার শিল্প দেখিনি আমি। বাংলা কবিতায় পেয়েছি। বাংলা গানে পেয়েছি। চিত্রে পেয়েছি। ঋত্বিক ঘটকের আগে বা পরে মনে পড়ে না বাংলার নিজস্ব আধুনিকতা নিয়ে কেউ ভাবিত।
েদিন প্রথম জাতিস্মর গানটি শুনেছিলাম সুমনদার কণ্ঠে, মনে হয়েছিল এই তো সেই চিরসময়ের কথা। এই তো সেই গান, যা আমার সত্তায় কিছু একটা ঘটিয়ে দিল। আমাকে আমার ক্ষুদ্র দু:খের বাস্তবতার থেকে এক নিমেষে নিয়ে চলে গেল অন্য কোনো বাস্তবতায়, যেখানে 'আমি' কেবল 'আমি' হিসেবে নেই, বরং অনেক জীবনের 'আমি' হিসেবে রয়েছি, কখনো বা 'তুমি' হিসেবেও রয়েছি। 'সে' হিসেবেও রয়েছি। কিন্তু তারা কোথায়? তাদের পাওয়ার জন্য তো আমাকে চলে যেতে হচ্ছে এমন কোনো ঘোরের মধ্যে, যেখান থেকে ফিরে আসা অসম্ভব প্রায়। পরক্ষনেই মনে হত ফিরতে চাইছি-ই বা কেন? ফিরতে হবে কেন আমাকে? বরং কুশল হাজরার মত যদি আমি থাকতে পারতাম সেই ঘোরের মধ্যে! যদি পারতাম বর্তমান সময়ের কথায় , ভাষ্যে, এই চিরসময়গুলোকে রচনা করতে! কিন্তু সময় নিষ্ঠুর। বড় নিষ্ঠুর। সে মাঝে মাঝে আসে আর তার বার্তার 'জিগির' তুলে দিয়ে যায় মনে। মনের বাঁধনদার না থাকলে তাকে লিখে রাখা খুব মুশকিল হয়।
এবার অনেকে বলবেন প্রসঙ্গে ফিরতে। সৃজিত মুখোপাধ্যায় পরিচালিত এবং কবীর সুমন সুরারোপিত জাতিস্মর ছবিটি দেখার আগে বুঝে উঠতে পারছিলাম না ছবিটি ঠিক কেন বাংলা ছবির জগতে তো বটেই, এই সময়ের প্রেক্ষিতেও ভীষণ ভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ১৭৬০ থেকে ১৮৩০ -- বাংলা সাহিত্য ও সঙ্গীতের ইতিহাসে এক স্বর্ণযুগ। বাংলার দেশজ আধুনিকতা তখন রূপ পাছে কবিয়ালদের গানে। তরজা, পাঁচালি, খেউড়, আখড়াই, হাফ আখড়াই, ফুল আখড়াই, দাঁড়া কবিগান, বসা কবিগান, ঢপকীর্তন, টপ্পা, কৃষ্ণযাত্রা, তুক্কাগীতি ইত্যাদির মধ্যে বাংলার নিজস্ব সমাজব্যবস্থা ভাষা পাচ্ছে। সংস্কৃত , পুরাণ , শাস্ত্র , সমকালীন সংকট , লৌকিক ধর্ম , সমাজ সব একসঙ্গে মিশে রূপ নিচ্ছে এক সম্মিলিত মহাকাব্যে। শিল্প , ভাষা , পাঠ এবং সৃজনের সেই সম্মেলনে ঋদ্ধ হচ্ছে বাংলার সমাজ, বাংলার কবিতা, গান। এক পূর্ণতার সময় এবং সন্ধিক্ষণের। আর ২০১৩-১৪, আরেক সন্ধিক্ষণের সময়। বেশ উদ্ভ্রান্ত এক সময়। যখন সময়কে ঘাড় ধরে নিজেকে চেনাতে হয়। আত্মবিস্মৃত এক সময়কে নিজের আয়নার দিকে নিয়ে যেতে হয়। সেই কাজটাই করে চলেছেন কবীর সুমন এতকাল ধরে। আর সেই কাজটাই করলো জাতিস্মর।
অনেকে এন্টনি ফিরিঙ্গি সিনেমাটার সঙ্গে এই ছবিটিকে তুলনা করছেন! এটা অত্যন্ত বোকার মত কাজ. কারণ ওই ছবিটিতে এন্টনিকে নায়ক করা হয়েছে। আর জাতিস্মর সিনেমাটাতে নায়ক এন্টনি নন. তিনি আমার পাশের বাড়ির লোক। তিনি একজন রক্তমাংসের কবি। বাংলাকে নিজের স্নায়ুর মধ্যে নিয়ে, বাংলা তথা ভারতীয় দর্শন, শাস্ত্র, সঙ্গীত আত্মস্থ করে, নিজের বাঁধনদারদের টাকা না দিতে পারা, সমাজের সঙ্গে দ্বন্দ্বে নিজেকে জীর্ণ করে ফেলা এবং সমাজের বিধানে নিজের প্রিয়তমাকে হারানো, কষ্টের মধ্যে দিয়ে, যন্ত্রনার মধ্যে দিয়ে সঙ্গীত ও কাব্যে নিজের রক্ত খোদাই করে রাখা এক চেনা কবি, যিনি নিজে মোমবাতির মত পুড়ে সঙ্গীতকে , কাব্যকে আলো দিয়ে গেছেন। এক শাশ্বত সংগ্রামের কাহিনী। শিল্পের শাশ্বত সেবকের কাহিনী। আর এই যন্ত্রনা এবং নিবেদনকে কোনো সময়ের বেড়াজালে বাঁধা যায় না। তিনি তাঁর সময়ে যেমন যন্ত্রণার সঙ্গে সহবাস করেছেন, তেমন-ই আজকের সময়েও কোনো কবি, কোনো শিল্পী, সংগ্রাম করছেন। তাঁদের সময়ে হয়ত পার্থক্য আছে, কিন্তু সংকটে নেই। দর্শনে নেই। এই জায়গাতে সময় হেরে যায়। সময় বাধ্য হয় দুই সময়কে মিলিয়ে দিতে। ঠিক তেমন-ই প্রেম। প্রেম এমন এক শাশ্বত বোধ, যাকে কোনো সময়ের বেড়াজালে বাঁধা যায় না। প্রেম এবং শিল্প -- এই দুই শাশ্বত বোধ-ই এই ছবিটির নির্মাতা। আর এই মিলিয়ে দিচ্ছে দুই সময়কে। যেন বা এই দুই বোধ-ই সেই উপলক্ষ যার জন্য সঙ্গীতের আধেয় চলচ্চিত্রের আধারে রূপ দিয়েছে একটি দর্শনকে।
পরিচালক অতীত থেকে বর্তমানে, বর্তমান থেকে অতীতে তাই নির্দ্বিধায় বিচরণ করেছেন। অত্যন্ত নিপুণ এবনং অভিনব ভাবনার পরিচয় পাওয়া যায় প্রথম দৃশ্যেই যখন কবীর সুমনের 'খোদার কসম জান' গানটির সঙ্গে ছায়ার মত হেঁটে যান ফিরিঙ্গি কবিয়াল। যখন ফিরিঙ্গি কালিবাড়ির সামনে কুশল হাজরা এন্টনি হয়ে যান মানসিক ভাবে। যখন তার স্মৃতির সরণী ধরে আমরা তাঁর বাস্তবতায় চলে যাই. আবার ফিরে আসি গুজরাটি এক তরুণের বাংলা সংগীতের খনন এবং প্রেম এর কাহিনীতে। যখন এন্টনি কবিয়ালদের সঙ্গে শোভাবাজার রাজবাড়িতে তরজায় ব্যস্ত, তখন চলে ব্যান্ডেমনিয়াম। আমরা দেখতে পাই, কথা, সঙ্কট এবং সংগ্রামগুলো একই। শুধু সময়ের পোশাক এবং ফর্ম আলাদা।
কবীর সুমন-এর সঙ্গীত এই ছবিতে এক ভিন্ন মাত্রার ক্যামেরা হয়ে কাজ করে। কবিয়ালদের গানগুলি আসলে সেই পটচিত্র, যার মাধ্যমে আমরা এক অন্য সময়ের বিচরণ করতে পারি। কবিয়ালদের তরজার মধ্যেই আছে সেই সময়ের সংকট। সেই সময়ের দর্পণ, আর সেই ইতিহাসকে আমাদের কাছে আনার জন্য সুমন দা বাঙালির ও বাংলার আবহমান সঙ্গীতের সমস্ত আঙ্গিক , সে তরজা গান, বা শ্যামাসঙ্গীত, বা কীর্তন, এমনকী কালোয়াতিকেও ব্যবহার করেছেন, যদি না আমার বুঝতে ভুল হয়ে থাকে! বলতে পারা যায়, কবিয়ালদের গানের মধ্যে দিয়ে এক লহমায় আমরা চলে যেতে পারি অতীতের সময়খন্ডে। আবার এ তুমি কেমন তুমি, সহসা এলে কী গানগুলির মধ্যে দিয়ে চলে আসতে পারি বর্তমানে। শুধু সিনেমাটোগ্রাফি দিয়ে দুই সময়্খন্ডের মধ্যে এই যাতায়াত ছিল অসম্ভব। কিন্তু সুমনদার সঙ্গীত সেই চলাচলকে সম্ভব করে তুলেছে। বিগত এক মাস জাতিস্মরের গানের মধ্যে ডুবে আছি। সিনেমাটির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীক ভাবে যুক্ত থাকা চিত্রনাট্যে সেই সংগীতের ভিজুয়ালাইজেশন ছবিটির এক প্রধান চরিত্র হয়ে উঠেছে বলাই বাহুল্য। কুশল হাজরা এবং রোহিতের সঙ্গে তাই কবীর সুমন এর সঙ্গীত হয়ে উঠেছে সময়ের বেড়াজাল ভেদ করে এপার অপার যাতায়াতের এক সেতুর মত। যে না থাকলে এই ছবিটি হতই না।
আর অন্য কিছু বিষয় নিয়ে লিখতে ইচ্ছে করছে না। আমাকে তো কেউ মাথার দিব্যি দেয় নি। আমি শুধু বুঁদ হয়ে আছি। বাকি বিষয়গুলি বহু আলোচিত এখন. তাই আমার না বললেও চলে। কিন্তু এ ছবিটি আমাকে কী দিল? আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে গেল আবহমানতার কাছে। বাংলার নিজস্ব মন্থরতাও ছবিটির নির্মানের মধ্যে অব্যাহত। তাই মনে হয়-- কে বা কারা এই ছবি নির্মাণ করেছেন? এই ছবি নির্মাণ করেননি সৃজিত। এ ছবি নির্মাণ করেছে স্বয়ং সময়। কারণ এখন, আত্মবিস্মৃতি থেকে ইতিহাসের স্মৃতির মধ্যে নিজের শিকড়কে খুঁজে পাওয়াটা জরুরি। আশা রাখি, এ ছবি দেখার পর আমরা দেশজ আধুনিকতার রস ও মর্মে নিজেকে দেখতে পাব। অন্তত নিজেকে খুঁজতে পারব। বেশি চিত্কার চারিদিকে। বড় বেশি গতি। কিন্তু কিছু কিছু বিষয় আজ একই আছে। সেই সব শাশ্বত বিষয়গুলির হাত ধরে আমরা কি পারব না আমাদের শিকড়ে পৌছতে? জাতিস্মর সিনেমাটির মত? জাতিস্মর গানটির মত?
এমন ছবি নির্মান করতে হয় না। নির্মিত হয়ে যায়। তবু সৃজিতকে ধন্যবাদ আর কবীরদাকে স্যালুট।
- হিন্দোল ভট্টাচার্য
Comments
Post a Comment